নাৎসি একনায়ক হিটলারই শুরু করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯আজ থেকে সত্তর বছর আগে ১৯৩৯ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল৷ সেই ঘটনার ঠিক দুইদিন আগে অর্থাৎ পয়লা সেপ্টেম্বর জার্মান সেনাবাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে সূচনা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের৷ আসলে পোল্যান্ডকে দখল করে আর থার্ড রাইখের আওতায় দেশটিকে এনে জার্মান স্বৈরশাসক আডল্ফ হিটলার তাঁর গোটা বিশ্বে প্রভুত্ব স্থাপনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছিলেন৷ বস্তুত, রাইনল্যান্ডকে সামরিকভাবে স্বনির্ভর করে, অস্ট্রিয়াকে তার সঙ্গে জুড়ে নিয়ে আর চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে সুডেনটেনল্যান্ড ছিনিয়ে নিয়ে দিকে দিকে জার্মান রাইশের বিস্তৃতির ইঙ্গিত হিটলার আগেই দিয়ে দিয়েছিলেন৷ তবে পোল্যান্ডের ঘটনায় ব্রিটেন আর ফ্রান্স যে অকস্মাৎ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে এমনটা ধারণায় ছিল না হিটলারের৷ তাই ব্রিটেন যখন তাদের বন্ধু দেশ পোল্যান্ডের প্রতি নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হিটলারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিল, তখন ‘ফ্যুরার' একটু বিস্মিত হয়েছিলেন মাত্র৷ হিটলারের অন্যায় জেদ আর লোভের ফলে ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল জড়িয়ে গেল বিশাল এক যুদ্ধের বাতাবরণে৷ শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ৷
ছয় বছর পর ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হল, পৃথিবীটা ততদিনে অনেকটাই বদলে গেছে৷ এই বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত খলনায়ক হিটলার আত্মহত্যা করেছেন৷ কারণ, মানবাধিকারের বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ তিনি এবং তাঁর সেনাবাহিনী করেছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে তার জবাবদিহি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত এই মানুষটি৷ হিটলারের নেতৃত্বে ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসা নাৎসি শাসনের জাতিবিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক মতবাদের কোপে ইউরোপ জুড়ে অন্তত ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল৷ বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সেইসব হত্যাযজ্ঞের ছবি গোটা বিশ্বকে শিহরিত করে দিয়েছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া এই যুদ্ধে অন্তত ষাট মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারান৷
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরাজিত জার্মানি তখন ভগ্নস্তূপ৷ বিজয়ী মিত্রশক্তির দখলে তখন জার্মানি৷ যে মিত্রশক্তিতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স৷ জোটবাহিনীর বোমায় বিদ্ধস্ত প্রায় সবকটি জার্মান শহর৷ অর্থনীতি ক্ষতবিক্ষত৷ পরিকাঠামো শূণ্য৷ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত একটা গোটা প্রজন্মের প্রায় সব তরুণ জার্মান৷ আন্তর্জাতিক মহলে জার্মানি তখন সকলের কাছে ব্রাত্য৷ যে দেশ কিনা আডল্ফ হিটলারের মত একজন উন্মাদ যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারীর হাতে নিজেদের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল বলে মনে করছে পৃথিবীর মানুষ৷ তাই জার্মানি সেদিন বিশ্বের দরবারে সর্বস্ব খোয়ানো, রিক্ত এবং চরম অপমানিত৷
বিশ্বের মানচিত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল এই বিশ্বযুদ্ধ৷ জার্মানি পূর্ব আর পশ্চিমে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল৷ পরমাণু বোমা উদ্ভাবন করে আমেরিকা হয়ে উঠল সুপার পাওয়ার৷ সোভিয়েত ইউনিয়নেরও তৈরি হল নতুন দিগদর্শন৷ শীতল যুদ্ধের সূত্রপাত হল, হল মেরুকরণ৷ শীঘ্রই গণতান্ত্রিক পশ্চিম আর কমিউনিস্ট পূর্ব জোটের অধিকারে এল বহুবার এই গ্রহকে ধ্বংস করার মত যথেষ্ট সংখ্যক পরমাণু অস্ত্র৷ এই নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাবে অবসান ঘটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের৷ ইটালি, জার্মানি আর দূরপ্রাচ্যে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিপুল মাশুল গুণতে গিয়ে চরম দেনায় তখন ডুবে গেছে ব্রিটেন৷ বাধ্য হয়ে একের পর এক উপনিবেশ থেকে সরে আসার পথ ধরতে হল ব্রিটেনকে৷ পরবর্তী দুটি দশক ধরে সেইসব দেশগুলি পেল স্বাধীনতা৷ কমনওয়েলথের সদস্য হল তাদের মধ্যে অনেকেই৷
১৯৩৯ সালের আগে পর্যন্ত যেসব দেশ ব্রিটিশ শাসনের দুর্দিন সহ্য করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাদের জন্য এক নতুন মোড় ঘোরার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই৷ কারণ ত্বরান্বিত হল তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এই যুদ্ধের ফলেই কিছুটা৷ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিপুল অর্থব্যয়ের ফলে বেকায়দায় পড়া ব্রিটিশ নীতিনির্ধাকরা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে এখন থেকে আর ব্রিটেন নয়, পাশ্চাত্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসাবে এবার আসরে চলে এসেছে আমেরিকা৷ ব্রিটেনকে মেনে নিতেই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই আধিপত্য৷ তবু, এইসব কিছুর জন্য কারওর পক্ষেই তাই বলে অ্যাডল্ফ হিটলারকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা সম্ভবপর নয়৷
একথা চরমতম সত্য যে হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গিকে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ইতিবাচক বলে মেনে নিতে পারবেন না৷ হিটলারের অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস করাও ছিল একটা উদ্দেশ্য৷ তবে ব্রিটেন তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হিটলার৷ ব্রিটিশ কলোনি বা উপনিবেশগুলি নিয়ে হিটলারের তেমন কোন মাথাব্যাথা ছিল না৷ হিটলারের পরিকল্পিত ‘থার্ড রাইখের' আওতায় সেসব উপনিবেশ এমনিতেই চলে আসবে, নয়ত সেগুলোকে দখল করে নেয়া হবে৷ সেখানকার মানুষদের পরানো হবে দাসত্বের শৃঙ্খল৷ এমনটাই ভেবেছিলেন হিটলার৷ নাৎসিরা তাদের স্বস্তিক চিহ্নটাকে এশিয়া থেকে নিয়েছিল বটে, তার মানে কিন্তু এরকম নয় যে এশিয়ার প্রতি কোনরকম শ্রদ্ধা বা সম্মান ছিল নাৎসিদের! স্বস্তিক চিহ্নটাকেও পা ল্টে দিয়েছিল তারা৷ হিটলার জাতিগতভাবে এশীয়দের ‘নীচুশ্রেণী'র বলে মনে করতেন, তাদের প্রতি স্বয়ং ‘ফ্যুরার' অর্থাৎ হিটলার এবং তাঁর অনুগামী নাৎসিরা সকলেই একইরকম তীব্র ঘৃণা পোষণ করত৷ জার্মানিতে পুলিশ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন হিটলার৷ জাতিগতভাবে যাদের নিম্নবর্গীয় বলে তাঁর ধারণা ছিল, নির্দ্বিধায় তাদের হত্যা করা হয়েছে হিটলারের শাসনে৷ তাঁর বিরুদ্ধে যে বা যারা মাথা তুলেছে, তাদের নিকেশ করা হয়েছে৷ যেসব ভূখন্ড জার্মানি সেদিন দখল করেছিল, সেখানে কোথাও কোন প্রতিবাদ বা আপত্তির চিহ্নমাত্র দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার টুঁটি টিপে ধরা হয়েছে৷ সেই চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হত্যাযজ্ঞের পর সুদীর্ঘ সত্তর বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এই নিদারুণ অন্ধকার দিনগুলিকে মানবজাতি আজও ভুলতে পারেনি৷
১৯৩৩ সালে হিটলারের অপশাসন যা ধ্বংস করতে চেয়েছিল, আজকের জার্মানিতে সেই মানবাধিকার আর মুক্ত গণতন্ত্র তার পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত৷ দুই জার্মানির শীতল যুদ্ধের অবসানের পর পুনরায় একত্রিত হয়েছে জার্মানি৷ গণতন্ত্র এই দেশে দারুণভাবে সফল৷ উন্নতমানের জীবনযাত্রার শরিক আজকের জার্মানির মানুষ৷ দীর্ঘ ছয়টি দশক ধরে প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে চমত্কার সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে জার্মান সরকার৷ আজকের একত্রিত ইউরোপের হৃদয়ে জার্মানির অবস্থান৷ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও জার্মানি পুনরুদ্ধার করেছে তার হৃত সম্মান৷ ইসরায়েলের মিত্রদেশ বলে জার্মানির পরিচয়৷ জাতিসংঘে রয়েছে এক পূর্ণ সদস্যের গৌরবময় আসন৷ আজকের এই উজ্জ্বল সময়ে দাঁড়িয়ে বিগত কয়েকটি দিন ধরে জার্মানরা নিশ্চয় অনেকবার ভেবেছেন সেইসব অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলির কথা, যেদিন হিটলার তাদের এই সুন্দর দেশকে, দেশের মানুষকে এক চরম অপমান আর গ্লানির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন৷
প্রতিবেদক: গ্রেহেম লুকাস, ভাষান্তর: সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক