1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সড়কে মৃত্যুফাঁদ, ক্ষতিপূরণের নামে শুধু প্রহসনই হয়তো বাড়বে

শামীমা নাসরিন
৬ অক্টোবর ২০২৩

চালকদের অসচেতনতা, যাত্রীদের অসচেতনতা, পথচারীর অসচেতনতা সব মিলেমিশে বাংলাদেশে মহাবিশৃঙ্খল এক সড়ক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

https://p.dw.com/p/4XBRs
নতুন বিধিমালায় দুর্ঘটনার পর ১০০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা আছে
নতুন বিধিমালায় দুর্ঘটনার পর ১০০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা আছেছবি: Sarkar Mannan

সেই সড়কে কেউ প্রাণ হারালে বা পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হলে তার জন্য এখন আইন করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সে ব্যবস্থার যাত্রা আগামী ২২ অক্টোবর শুরু হতে চলেছে বলে জানা গেছে।

একজন অনলাইন সংবাদকর্মী হিসেবে ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে আমি দেখেছি মাসে দুই একদিন খুব বড় ঘটনা ছাড়া বাকি দিনগুলোতে বিশেষ করে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে সকাল শুরুই হয় সড়ক দুর্ঘটনার খবর দিয়ে।

প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমিও নিদারুণ এক আতঙ্কে স্রষ্টার নাম জপতে থাকি। কি জানি, কাজ শেষে সুস্থ অবস্থায় প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরতে পারবো তো। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়ার শিমা খাতুনও হয়তো আমার মত স্রষ্টাকে স্মরণ করে গত ১ অক্টোবর বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কাজ শেষে সন্ধ্যায় শিমা সন্তানদের কাছে ফিরছিলেন৷ কুমারখালির মহাসড়কে  একটি ট্রাক পেছন থেকে তার স্কুটিকে ধাক্কা দেয় আর  রাস্তায় পড়ে যাওয়া শিমাকে চাকায় পিষে রেখে অবলীলায় চলে যায় যায়। আধাঘণ্টা শিমার মৃতদেহ সড়কে পড়েছিল। জেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের বজরুখ বাঁখই গ্রামের হারুন প্রামাণিক এখন হয়তো নতুন সড়ক পরিবহন আইনে স্ত্রীর মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আবেদন করবেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সংযুক্ত করে। যার বিধিমালা প্রকাশ পায় গত ২৭ ডিসেম্বর। বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার পাঁচ লাখ, আহত ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারলে তিন লাখ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা থাকলে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে।

যদিও একটি প্রাণের দাম মাত্র পাঁচ লাখ বা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষটি ক্ষতিপূরণের তিন লাখ টাকা দিয়ে ঠিক কিভাবে নিজের অসহায় অবস্থা মোকাবেলা করবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তারপরও কথায় আছে না, ‘নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো'। তাই ক্ষতিপূরণ দেওয়া যে ব্যবস্থা শুরু হতে চলেছে সেটা নিঃসন্দেহে সরকারের ভালো উদ্যোগ।

কিন্তু এ উদ্যোগ আসলে কতটা বাস্তবায়ন যোগ্য? সাদা চোখে আমার কাছে এ আইনকে কাজীর গরু ছাড়া আর কিছু তো মনে হচ্ছে না। যেটি কাগজে থাকবে কিন্তু গোয়ালে তার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কেনো এ কথা বলছি, আসুন তার সপক্ষে কিছু যুক্তি দেখাই। শুরুতেই ক্ষতিপূরণের তহবিল নিয়ে বলি। বিআরটিএ-র হিসাব বলছে, গত বছর সড়কে প্রাণ গেছে ৪ হাজার ৬৩৮ জনের। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৪৮ জন। যদিও বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। তারপরও এ হিসাব মেনে শুধু ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ক্ষতিপূরণের জন্য দরকার ২৩২ কোটি টাকা। সঙ্গে আহতদের জন্য আরো প্রায় ১৩৯ কোটি। ট্রাস্টের খরচ মিলিয়ে প্রতিবছর এই খাতে গড়ে ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন।

সরকার এবছর এ খাতে বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখেনি, দেবে সামান্য কিছু অনুদান। আর সঙ্গে মোটরযান মালিকদের চাঁদা। মেরে কেটে তাতে সব মিলিয়ে দেড়শ কোটি টাকার মত সংগ্রহ করা যাবে বলে নানা পত্রিকা ঘেঁটে জেনেছি। বাকি টাকা কে যোগাবে? ভূতে নিশ্চয়ই না!

এরপর আসি জনবল নিয়ে। প্রায় নয় মাস আগে বিধিমালা জানিয়ে গেজেট জারি হলেও এখনো এ আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব একটা জানে না। তার প্রমাণ এ কয়েক মাসে মাত্র ৩১০টির (১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) মত আবেদন জমা পড়া। তারমধ্যে ৬৩টির অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে এবং নিহত ৩৮ জনের পরিবার এবং আহত ২৫ জন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে।

২২ অক্টোবরের পর এ পরিস্থিতি কিন্তু থাকবে না। গণমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে খবর প্রচার হবে। বাড়বে মানুষের জানাশোনা। সেইসঙ্গে বাড়বে ক্ষতিপূরণের দাবিতে আবেদন। শুধু ক্ষতিগ্রস্তরাই ক্ষতিপূরণ চাইবে, বিষয়টা কিন্তু এতটাও সরল নয়। অসৎ লোকের অভাব তো এ দেশে নেই। তাই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার জন্য বড় আকারের জনবল প্রয়োজন। যেটা এই মুহূর্তে বিআরটিএ-র হাতে নেই।

গত ২৪ জুন অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ফিরছিলেন কমলা পারভীন। ফেরার পথে ভাঙা এক্সপ্রেসওয়েতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় চালকসহ আট আরোহীর সবাই মারা যান। ফরিদপুরের মেয়ে হওয়ায় খবরে নিজ জেলার নাম শুনলে খানিকটা কান খাড়া করে রাখি।

দুর্ঘটনার ২৫ দিন পর অন্যের কাছে নতুন আইনের খবর জেনে কমলার স্বামী মো. আলমগীর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আবেদন করেন।

ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হবে জানতে পেরে আলমগীরের ফোন নম্বর যোগাড় করে তাকে ফোন করেছিলাম সর্বশেষ অবস্থা জানতে। তিনি জানান, দিন ১৫ আগে ফরিদপুর এসে বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে একটি অঙ্গীকারনামায় তিনি সই করে গেছেন। ২২ অক্টোবর যাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে সে তালিকায় তার নাম আছে কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারলেন না।

সড়ক দুর্ঘটনায় এতদিন আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছিল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। যদিও সে সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। তারপরও কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশজুড়ে বেশ হইচই ফেলেছিল।

তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের কথা আপনাদের মনে আছে? ২০১৮ সালে ঢাকার কাওরান বাজার এলাকায় স্বজন পরিবহন ও বিআরটিসি বাসের রেষারেষির মধ্যে বিআরটিসি বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের হাত দুই বাসের চাপায় পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৩ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে যায় এই তরুণ। তার পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত পরের বছর রাজীবের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যার অর্ধেক দেবে স্বজন পরিবহন এবং অর্ধেক বিআরটিসি। নানা ঘাট ঘুরে নানা আদেশ এলেও এখনো এক টাকাও ক্ষতিপূরণ পায়নি রাজীবের পরিবার। ফোনে রাজীবের মামা জাহেদুল এমনটাই জানালেন। হতাশ হয়ে তিনি বলেন, "আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিলেও টাকা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি। দুই বাস কোম্পানির কেউ ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি না। আমরা সাধারণ মানুষ, অতো ক্ষমতা কোথায়। আমাদের উকিলও বলেছেন, আদালত রায় দিতে পারে, টাকা তো তুলে দেবে না। আমাদের তাই আর কিছু করার নাই।”

শামীমা নাসরিন, সাংবাদিক
শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা, ভোগান্তি, একের পর এক রায়-পাল্টা রায়, পরিবহন ক্ষেত্রের প্রভাবশালীদের সমানে অসহায় সাধারণ মানুষ তাই মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ভয়ঙ্কর রোলার কোস্টারে উঠতে চায় না। আবেদন প্রক্রিয়ায় এখনো কিছু খামতি থাকলেও সেই তুলনায় নতুন বিধিমালা কিন্তিু বেশ সহজ। এতে দুর্ঘটনার পর মোটামুটি একশ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা আছে।

অথচ গেজেট জারির পর এই সাড়ে আট মাস কেউ ক্ষতিপূরণপায়নি বলেই জেনেছি। হয়তো উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। উদ্বোধন হয়ে গেলে নিয়ম মেনে যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়া সত্যিই শুরু হয় তবে দুর্ঘটনায় পথে বসে যাওয়া পরিবারগুলো হয়তো নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে। তারিখের পর তারিখ আর এক আদালত থেকে আরেক আদালতের দরজায় তাদের ছুটতে হবে না।

কিন্তু যেভাবে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধি রাম সর্দার' হয়ে এ উদ্যোগের যাত্রা শুরু হচ্ছে, তাতে আমি তো অন্তত আশাবাদী হতে পারছি না।