1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাম্প্রদায়িকতা ও একটি গরুর রচনা

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সাম্প্রদায়িকতা যখন রাজনীতির অভিমুখ হয়ে যায়, সহিংসতা তখন এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়৷ ভারত সে পথেই হাঁটছে৷

https://p.dw.com/p/4NJg4
ভারতে এর গরুকে সাজানো হয়েছে৷
১৪ ফেব্রুয়ারি সকলকে গরু জড়িয়ে ধরে সেলফি পোস্ট করতে বলেছে ভারতের অ্যানিম্যাল হাসবেন্ডারি মন্ত্রণালয়৷ছবি: AP

গরু বললে দীর্ঘদিন কেবল মহেশের কথা মনে পড়তো৷ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই গল্পে গফুর মিঞাঁ ছিলেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিল না৷ বস্তুত, আমাদের ছোটবেলাতেও ১৪ ফেব্রুয়ারির তত নাম মাহাত্ম্য ছিল বলে মনে পড়ে না৷ ভালোবাসার কিশোর-মন সরস্বতীপুজোকেই ভ্যালেন্টাইনস ডে-র পরিপূরক করে ফেলেছিল৷ সরস্বতীপুজোর সেই প্রেমকাহিনি ফুটনোট-সহ ফেসবুকে লিখে সম্প্রতি যারপরনাই কেস খেয়েছেন অধমের এক বন্ধু৷ একটি পুজোর দিনকে কেন ভ্যালেন্টাইনস ডে-র সঙ্গে তুলনা করা হবে, কেন সেই দিনটিকে প্রেমের মতো এক অকিঞ্চিৎকর, ম্লেচ্ছ ভাবনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নবানে বিদ্ধ বন্ধুর ফেসবুক প্রোফাইল৷ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেই বন্ধুর বিরুদ্ধে রীতিমতো ইমেল করে অভিযোগ জানানো হয়েছে৷ তার অতীত ইতিহাস, রাজনৈতিক অবস্থান এবং ধর্মীয় ভাবনার এনসাইক্লোপিডিয়া তুলে ধরা হয়েছে সেই অভিযোগপত্রে৷ এরপর সেই অভিযোগ গৃহীত হবে কি না, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়৷ 

যে কোনো গরুর রচনার মতোই এই লেখাও গফুর থেকে হিন্দুত্ববাদে পৌঁছে গেছে এক প্যারাগ্রাফেই৷ ফের গরুতে ফেরা যাক৷

ভারতীয় অ্যানিম্যাল হাসবেন্ডারি মন্ত্রণালয় অতি সম্প্রতি একটি নোটিস জারি করেছে৷ তাতে বলা হয়েছে, ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি (ভারতীয় সংস্কৃতি কেবলমাত্র বৈদিক হলো কবে থেকে, তার কোনো উল্লেখ নেই চিঠিতে) অবলুপ্তির পথে৷ বৈদিক সংস্কৃতি আমাদের গরুর প্রতি অনুরক্ত করে৷ পশ্চিমি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে আমাদের এইসমস্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমশ ধ্বংস হয়েছে৷ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি সকলকে গরুকে জড়িয়ে ধরে সেলফি পোস্ট করতে হবে৷

পাঠক, ভুল পড়েননি৷ ভারতের একটি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রণালয় সই করে, স্ট্যাম্প মেরে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে৷ চিঠির টাইটেলে ‘কাও হাগ ডে’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এক শ্রেণির মানুষ ভ্যালেন্টাইনস ডে-র আগে থেকেই চিঠির নির্দেশ পালন করতে শুরু করেছেন৷ আরেক শ্রেণির মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে হাস্যরসে মাতোয়ারা হয়েছেন৷ আর আমার ভাবনায় গফুর মিঞাঁ কেবলই ফিরে আসছেন মহম্মদ আখলাক হয়ে৷ ফ্রিজে গোমাংস থাকতে পারে এই অপরাধে একদিন যাকে পিটিয়ে ভ্যানিশ করে দেওয়া হয়েছিল৷ ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে কাও হাগ ডে পালন করার ফরমান পড়েই আশঙ্কা হলো, দিকে দিকে আরো আকলাখ-কাণ্ডের ফ্লাডগেট খুলে গেল না তো?

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

ভালোবেসে গরুর সঙ্গে সেলফি তুললে, গরুকে জড়িয়ে ধরলে আপত্তি থাকার কথা নয়৷ কিন্তু যারা সে কাজ করছে না, তাদের উপর হিন্দুত্বাবাদী ব্রিগেড চড়াও হবে না তো! পশ্চিমি সংস্কৃতি বন্ধ করার নামে ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে পাবে-ক্লাবে-বারে ঢুকে উগ্র তাণ্ডবের সাক্ষী এই সমাজ৷ কেবলমাত্র ধর্মের জন্য, বর্ণের জন্য পিটিয়ে খুন করে দেওয়ার দৃষ্টান্ত আছে এই সমাজেই৷ এই সমাজ প্রশ্রয় দেয় লাভজিহাদের মতো শব্দবন্ধ৷ এই সমাজ কয়েহাজার দাঙ্গার সাক্ষী৷ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ জুড়ে যে ইতিহাস বয়েই চলেছে৷ তাই আশঙ্কা হয়৷

আশঙ্কা বাড়ে, যখন দেখি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সেই উগ্রতাকেই ব্যবহার করছে বিরোধীপক্ষ৷ পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও ধর্ম হয়ে উঠেছে রাজনীতির ভাষা৷ গোটা সমাজ, গোটা রাজনীতি এক আশ্চর্য সংকীর্ণ ধর্মের আধারে ঢুকে পড়ছে৷ এ আধারে বড়ই আঁধার৷ আলো দেখানোর মতো লাইটম্যান নেই আশেপাশে৷ প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক টেনশন তৈরি হচ্ছে৷ পাশাপাশি বসবাস করা মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করছে৷ মূর্খ, সহিংস, ঘৃণার এক সভ্যতা রচিত হচ্ছে প্রতিদিন৷ সাম্প্রদায়িকতাই কার্যত ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতির মূলস্রোতের ভাষায় পরিণত হয়েছে৷

গরুকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক ভারতীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে একজন গফুর মিঞাঁর তাই বড্ড প্রয়োজন৷

২০১৯ সালের এপ্রিলের ছবিঘরটি দেখুন...