1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘গবেষণা না করে কর্মসূচি নেয়া হয়েছে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৫ ডিসেম্বর ২০২০

মহামারির মধ্যেই পার হল বছর৷ অর্থনৈতিকভাবে কেমন গেল ২০২০ সাল? সামনের বছরের চ্যালেঞ্জ আর সম্ভাবনাই বা কী? এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের পরামর্শক ও সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন৷

https://p.dw.com/p/3nD9V
‘‘সারা বছর স্কুল বন্ধ ছিল৷ এভাবে যদি বন্ধ থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে৷’’
‘‘সারা বছর স্কুল বন্ধ ছিল৷ এভাবে যদি বন্ধ থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে৷’’ছবি: DW/R. Murtuza

তার মতে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ আত্মবিশ্বাস বাড়াবে৷ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে৷ শুধু অর্থায়ন নয়, কারিগরিভাবেও বাংলাদেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।

ডয়চে ভেলেকরোনা মহামারির মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কেমন গেল বছরটি?

. জাহিদ হোসেন: হঠাৎ করে একটা দুর্যোগ এল, ফলে সবকিছু বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছরটি খুব খারাপ গেছে৷ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য৷ আর শহরে যারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের জন্যও খারাপ গেছে৷ বছরের শেষের দিকে কিছুটা পুনরুদ্ধার হলেও আগের জায়গায় ফিরে আসেনি৷

করোনাতে তো সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে৷ এর কতটা সুফল মিলেছে?

বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে৷ সুফলের বিচার যদি হয়, কোথায় অর্থ ছাড় বেশি হয়েছে? সে হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজটি দেওয়া হয়েছে বড় শিল্প, গার্মেন্টস ও সেবা খাতে সেখানে বেশি সুফল মিলেছে৷ গার্মেন্টসেই সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো দেওয়া হয়েছে৷ তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সমস্যা হয়েছে৷ এদের জন্য যে প্যকেজ দেওয়া হয়েছে সেটা তাদের কাছে পৌঁছানো যায়নি

করোনা মহামারি শুরুর প্রথম দিকেই সরকার প্রণোদনার ঘোষণা দেয়৷ এই প্রণোদনা দিতে কোন গবেষণা বা ক্ষতিগ্রস্থদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা গেছে কি-না?

করোনা মহামারির প্রভাবটা এত ব্যাপক ছিল যে, সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ কিছু ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই চিহ্নিত হয়ে গেছে৷ আসলে চিহ্নিত করার চেয়ে তাদের কাছে পৌঁছানোর পথটা চেনা জরুরি ছিল৷ সরকার যে পথটা বেছে নিয়েছে সেটা হল ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে টাকাটা পৌঁছানো৷ ব্যাংকিং সিস্টেমটা যেখানে পৌঁছাতে পারে সেখানে পৌঁছেছে৷ আর যেখানে পৌঁছাতে পারে না সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল৷ বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য৷ যাদের একাউন্ট ছিল না, তাদেরটা খোলা হল৷ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে সেখানে পৌঁছানো হয়েছে৷ সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় যেসব পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে সেখানে গবেষণা না করে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে৷ ফলে সেখানে শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে৷

পদ্মা সেতু চালু হলেই দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এমনটি বলা হচ্ছে৷ শুধুমাত্র সেতুটি চালু হলেই কি এই উন্নয়ন হবে? না-কি এর সঙ্গে সহযোগী কিছু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দরকার?

আমরা উন্নয়ন বলতে কি বুঝি সেটা আগে পরিস্কার হতে হবে৷ আমার কাছে উন্নয়ন হল যেটা জনগনের দুর্ভোগ কমায় স্থায়ীভাবে৷ সে হিসেবে সেতুটি চালু হলেই কিছু উন্নয়ন হবে৷ যেমন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের এখন আসা যাওয়া করতে ফেরিঘাটে একটা বড় সময় চলে যায়৷ নদীর পানি কমে গেলেও দুর্ভোগ, বেড়ে গেলেও দুর্ভোগ৷ এটা প্রকৃতির উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়৷ আর সেতুটি চালু হলে সেই দুর্ভোগ থাকবে না৷ অনেক ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে সেতুটির কারণে আমাদের একশ কিলোমিটার যাতায়াতের সময় কমবে৷ কিন্তু উন্নয়ন বলতে যদি আপনি বোঝেন শিল্পায়ন বা কৃষির আধুনিকায়ন৷ তাহলে পদ্মা সেতু দ্বার উন্মোচন করছে৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে সংস্কার বা রেগুলেশন লাগবে৷ ওই এলাকায় বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো লাগবে৷ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছাতে হবে৷ অভ্যন্তরীণ গ্রামগুলোর সঙ্গে সংযোগ সড়ক করতে হবে৷

ড. জাহিদ হোসেন

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের অর্থনীতির উপর কি কোন বিশেষ চাপ পড়ছে বা পড়বে?

আমার মনে হয় না, নিজস্ব অর্থায়নের ফলে কোন বিশেষ চাপ পড়েছে৷ অর্থায়নের জটিলতায় নির্মাণ কাজ শুরু করতে দেড়-দুই বছর দেরি হয়ে গেছে৷ ফলে খরচ বেড়ে গেছে৷ আসল বাজেটের চেয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন গুন বেশি লাগছে৷ জটিলতা না থাকলে হয়তো ২০১৮ সালেই এটা শেষ হতো৷ পদ্মা সেতুর জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পাওয়ার কথা ছিল সেখান থেকে পাইনি৷ কিন্তু তারা আবার অন্য খাতে অর্থায়ন করেছে৷ ওই খাতগুলোতে তারা অর্থায়ন না করলে হয়তো সরকারকে করতে হতো৷ ফলে এখানে সরকারের অর্থ বেঁচে গেছে৷

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুটি নির্মাণ করছে৷ বাংলাদেশের এই সক্ষমতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

এটা খুবই ইতিবাচক একটা দিক৷ শুধু অর্থায়ন নয়, কারিগরি দিক থেকেও এটা একটা জটিল প্রকল্প৷ এটা করতে পারা আমাদের আত্মবিশ্বাসে একটা বড় অবদান রাখবে৷ এখান থেকে ভবিষ্যত প্রজন্ম উৎসাহ পাবে৷ কারিগরিভাবেও আমরা সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছি৷ এটা চালু হলে জাতীয় আত্মবিশ্বাসেও বড় ধরনের কাজ করবে৷ এটা একটা উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে৷ এটা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে৷

বলা হচ্ছে, করোনার মধ্যে কৃষিই একমাত্র খাত যেটি আমাদের অর্থনীতির উপর অভিঘাত পড়তে দেয়নি? সরকার যে প্রণোদনা পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে কৃষক কৃষির জন্য কতটা যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছে?

এই সেক্টরে বেশ কিছু যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বোরো কাটার সময় করোনার প্রভাবটা বেশি ছিল৷ তখন লকডাউন ছিল৷ তখন তো মনে হচ্ছিল, ক্ষেতেই ফসল নষ্ট হয়ে যাবে৷ বিশেষ করে হাওড় এলাকায়৷ তখন কিন্তু সরকার শ্রমিকদের চমৎকারভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সেখানে নিয়ে গেছে৷ ফলে বোরোতে কোন প্রভাব পড়েনি৷ এতে কৃষকের ফসলটা যেমন ঘরে উঠেছে, তেমনি যারা কাজ করেছে তারা অর্থ পেয়েছে৷

করোনার মধ্যেই সুদহার এক অঙ্কে আনা হয়েছে৷ এতে ব্যাংকগুলোসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়েছে?

করোনার কারণে তো বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে৷ সেটা উৎপাদন বা বাণিজ্যের জন্যে বলেন৷ সব সুদ এক ডিজিটে আনায় মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং সেক্টরকে ক্ষতি করবে৷ যারা ঋণ নেন তারাও ঠিক ঋণ পাবেন না৷ বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান৷ যেখানে ঝুঁকি অনেক বেশি৷ এসএমই খাতটা তো আমাদের শিল্প খাতে কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি৷ ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে তাদের পোষাবে না৷ ফলে তারা ঋণ নিতে চাইবেন না৷ এটা একদিকে যেমন ব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষতি করবে, অন্যদিকে যারা ঋণ নিতে চাইবেন তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন৷

আগামী বছর বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ কী এবং কী সম্ভাবনা আপনি দেখেন?

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা৷ আমরা প্রথম ঢেউ থেকেই বেরিয়ে আসতে পারিনি৷ আগামী বছর তো ভ্যাকসিন আসছে৷ সেটা সবার কাছে পৌঁছানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ আগামী বছর দেখা যাবে আপনার কাছে ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট না থাকলে হয়তো বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সগুলো টিকিট বিক্রি করবে না৷ শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হবে ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট লাগবে৷ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় তো আবারও লকডাউন দেওয়া হচ্ছে৷ আমাদের যে বড় বাজারগুলো আছে, সেগুলো আবার পুনরুদ্ধার করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ৷ রাজস্ব খাতের চ্যালেঞ্জটা হল, এবার যেহেতু প্রবৃদ্ধি আগের মতো হবে না, সেখানে রাজস্ব আদায়ে টার্গেট পূরণ হবে না৷ সরকার অবশ্য কৃচ্ছ্রতা সাধনের কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে৷ আরেকটা চ্যালঞ্জ হল সারা বছর স্কুল বন্ধ ছিল৷ এভাবে যদি বন্ধ থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে৷ স্কুল খুলে নিরাপদভাবে চালু রাখা হবে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ আর সম্ভাবনা হল, করোনার মধ্যে কিছু নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসাগুলোর গুরুত্ব আগের চেয়ে আরো বাড়বে৷ এখানে আমরা সুযোগটা নিতে পারি৷