1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সংঘাতে বিভেদ বাড়ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২১ জানুয়ারি ২০২৪

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা আওয়ামী লীগকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এই সহিংসতা তৃণমূলে স্থায়ী বিভেদ তৈরি করলে তা হবে দলটির জন্য বড় ক্ষতির কারণ।

https://p.dw.com/p/4bVoQ
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সামনে উপজেলা নির্বাচনে আরো বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সামনে উপজেলা নির্বাচনে আরো বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরাছবি: Khokan Chowdhuri

আর সামনে উপজেলা নির্বাচনে এই বিভেদ আরো বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

নেতারা  বলছেন, বিএনপি ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বাইরেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের স্বতন্ত্র নির্বাচন করার অনুমতি দেয়া হয়। সেই উদ্দেশ্য সফল হলেও নির্বাচনের আগে এবং বিশেষ করে নির্বাচনের পরের সহিংসতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। সোমবার সন্ধ্যায় আওামী লীগের নির্বাহী কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে এই বিষয়টিই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে জানা গেছে।

কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারগুলো অসহায় অবস্থায় আছেন। নির্বাচনের পর ১৩ জানুয়ারি রাতে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ- সোনাইমুড়ি আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের  স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহা. আতাউর রহমানের নির্বাচনী এজেন্ট শাহেদুজ্জামান পলাশকে(৩৫) কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। 

এই হত্যাকাণ্ডের পর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল আসামিরা এখনো আটক হয়নি বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী সামিনা আক্তার। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন," আমি দুইটি শিশু সন্তান নিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের তেমন কোনো সম্পদ নেই। আমার স্বামী যা আয় করতেন তাই দিয়ে চলতাম। তিনি মুরগির খামার দিয়ে চলতেন। এখন খামার দেখারও লোক নাই।”

তার কথা," আমার স্বামী স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট করেছেন। এটাই তার অপরাধ। নির্বাচনের আগেও তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। তিনি নিহত হওয়ার পর নেতার এসে দুই-একদিন এসে খোঁজ নিয়েছেন। পুলিশ এসেছে। কিন্তু আমি তো আমার স্বামীকে ফিরে পাবনা।”

নিহতের  চাচা ও সোনাইমুড়ি উপজেলার নাগেশ্বর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য এবং ৮ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জাহাঙ্গির হোসেন বলেন," আমাদের এখানে কেউ নৌকার নির্বাচন করেছে, কেউ স্বতন্ত্র। সবাই আওয়ামী লীগ। আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলেও আওয়ামী লীগ করত। আমরা মিলেমিশে ছিলাম। কিন্তু তাকে হত্যার পর এখন বিভেদ দেখা দিয়েছে। যদি অপরাধীরা শাস্তি পায় তাহলে হয়তোবা বিভেদ থামানো যাবে।”

এই হত্যাকাণ্ডের জন্য নৌকা প্রতীকের লোকজনকে দায়ী করা হচ্ছে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মোরশেদ আলম জয়ী হয়েছেন।

'দুইটি শিশু নিয়ে আমি অসহায় হয়ে গেছি'

একইভাবে ঝিনাইদহে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন বরুন কুমার ঘোষ(৪৫) নামে নৌকার এক কর্মী। নির্বাচনের পর ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঝিনাইদহের ঘোষপাড়া এলাকায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ঝিনাদহ-২( হরিণাকুণ্ড-সদর একাংশ) আসনে নৌকার প্রার্থী তাহবীজ আলম সিদ্দিকীর পক্ষে নির্বাচন করেন। এতে ক্ষুব্ধ ছিলো স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসের শাহরিয়ার জাহেদীর লোকজন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র এই প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

হরিণাকুণ্ড থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান বলেন," এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্ব শত্রুতার জেরে হয়েছে বলে আমরা জানি। নির্বাচনে জয়-পরাজয়, প্রভাব এসব ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। নির্বাচনের পর এরকম জয় পরাজয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব শত্রুতার জেরে অনেক সময়ই সহিংসতা হয়। কেউ কেউ সুযোগ নেয়।”

একইভাবে নেত্রকোনা-৩( কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনে নির্বাচনের পরদিন ৮ জানুয়ারি রাতে নিহত হয়েছেন নুরুল আমিন(২৮) নামে এক তরুন। নির্বাচনের পরে নৌকার প্রার্থী অসীম কুমার উকিল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ইফতিখার উদ্দিন তালুকদারের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

দেশের আরো কয়েকটি এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, নির্বাচনের পর নৌকার প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব বেড়ে গেছে। তারা সবাই আওয়ামী লীগ হওয়ায় যার যার প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত এটা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা মনে করেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এই দ্বন্দ্বের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।

সংসদ নির্বাচনের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনে নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায়  সাত জন নিহত হয়েছেন। সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৩৪৫টি। আট পুলিশ সদস্যসহ চার শতাধিক আহত হয়েছেন। সরকারের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

আর  হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট  সোসাইটি(এইচআরএসএস) নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে নির্বাচনি সহিংসতায় ১৫ জন নিহত এবং দুই হাজার ২০০ জন আহত হয়েছেন। এইসব সংঘাত সংঘর্ষের প্রায় সব ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ঝিনাইদহে ৪০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়িতে ৪০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

ওই জায়গাগুলোর কোথাও দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথাও বলছে সংগঠনটি।

এছাড়াও পিরোজপুর, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, রাজশাহী ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন জায়গার হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন আহমেদ বলেন,"  তৃণমূল আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্ব›দ্ব আগে থেকেই ছিলো। আমাদের এখানে আগের এমপি সাহেব নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেননি।  নির্বাচনের সময় তাই নেতা-কর্মীরা ভাগ হয়ে গেছে। আগে-পরে সংঘর্ষ সংঘাত হয়েছে। এখন আমরা চেষ্টা করছি এটা নিরসনের। আমাদের কেন্দ্র থেকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”

মানবাধিকার সংস্থাটির গবেষণা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন," আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি পাওয়ায় নির্বাচনের আগে থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগে নানা গ্রুপ ও ফোরাম সৃষ্টি হয়। সেখানে বিভেদ সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের পরে তার জের চলছে। নির্বাচন শেষ হলেও সেই গ্রুপ বা ফোরামগুলো আছে।  তার জের এবং প্রভাব বিস্তার ও ধরে রাখার চেষ্টার কারণে এসব হচ্ছে।”

তিনি বলেন," সহিংসতা না থেমে  অব্যাহত থাকার কারণ হলো এখানে পুলিশ প্রশাসন তাদের মতো ব্যবস্থা নিতে পারছেনা। কারণ যারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন তারা দুই গ্রুপ হলেও সবাই আওয়ামী লীগ। ফলে কোনো এক গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে আরেক গ্রুপের চাপে পড়েন তারা। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পুলিশ যেভাবে অ্যাকশনে যেতে পারে এইসব ঘটনায় পারেনা। ফলে সহিংসতা অব্যাহত আছে।”

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারাও উদ্বিগ্ন। এরইমধ্যে তৃণমূলে সংযত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ একটি বর্ধিত সভা করারও পরিকল্পনা নিচ্ছে। আর সোমবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে।

'নির্বাচনের পরেও নানা গ্রপ, ফোরাম, বিভেদের জের চলছে'

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম এমপি বলেন," যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে। যখন যেখানে হয়েছে সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন থেমে গেছে। আওয়ামী লীগের পদে থাকা কেউ এসব ঘটনায় জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাকি কাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করছে।”

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন," এতে তৃণমূলে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে কী না। আরো সংঘাত হবে কী না। এগুলো তো আগাম বলা যায়না। আমরা কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলে সফর শুরু করব। জেলায় জেলায় যাব। আর একটি বর্ধিত সভার পরিকল্পনা আছে। সোমবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক আছে।”

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সংসদ নির্বাচনে যে বিভেদ আওয়ামী লীগের তৃণমূলে হয়েছে তা যাতে আর  না বাড়ে সেজন্য ওই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নাও থাকতে পাওে আওয়ামী লীগের।

'সহিংসতা বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে'

আওয়ামী লীগের আরেকজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি জানান," উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হওয়ার আলোচনা আছে। তবে এব্যাপারে এখানো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সোমবারের বৈঠকে এইসব বিষয়সহ সাংগঠনিক  সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি বলেই এখন সহিংসতা থেমে গেছে। যা হয়েছে তা বিাচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে হয়েছে।”

প্রসঙ্গত, এবার  সংসদ  নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রাথী  জয়ী হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৯ জন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র।