1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বাড়ছে?

সমীর কুমার দে ঢাকা
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২

গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷ কেন বাড়ছে এমন প্রবণতা এই প্রশ্নের খোঁজে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷

https://p.dw.com/p/4Gfi2
Symbolbild Sucht Drogen Tabletten Pillen Tablettensucht
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance

‘‘আমি যদি বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারতাম, তাহলে এটা হতো না৷ এখন আমি অধঃপতিত হলাম৷ আমি আপনাদের কাছে একদম ক্ষমার অযোগ্য, তবুও সবার কাছে ক্ষমা প্রর্থনা করছি৷’’

এমন একটি চিরকুট লিখে গত জানুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অনিক চাকমা৷

সারাদেশে গত ৮ মাসে আত্মহত্যা করেছেন তিনশ ৬৪জন শিক্ষার্থী৷ আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে একশ একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ জরিপটি বলছে, ২০১৮ সালে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১১জন এবং তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১৯জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০২০ সালে দেশে ৪২জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ আর চলতি বছরের ৮ মাসেই আত্মহত্যা করেছেন ৫০ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী৷ 

আত্মহত্যার এই প্রবণতা সমাজের নানা স্তরের মানুষের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে৷  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে৷ সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার এই প্রবণতা বাড়ছে৷ আর দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে৷

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছে পরিবারের চাপ: জোবেদা খাতুন

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রণে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে৷ শিশু বয়স থেকেই মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷ করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে৷ রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশোনার চাপ৷ এছাড়া পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে৷ শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বাড়ছে৷’’ 

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এ বছরের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করা তিনশ ৬৪  শিক্ষার্থীর মধ্যে একশ ৯৪ জন (৫৩ দশমিত ৩০ শতাংশ) স্কুলের৷ কলেজ শিক্ষার্থী ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং মাদ্রাসার ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ৷ ২০২১ সালে ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল৷ আর নতুন তথ্য বলছে, ছাত্রীদের মধ্যে এই হার বেশি৷ এবছর আত্মহত্যা করা ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশই (২২১ জন) ছাত্রী৷ বাকি ১৪৩ জন ছাত্র৷

শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপকে আত্মহত্যার হার বাড়ার অন্যতম কারণ মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা৷ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হচ্ছে৷ কোভিডের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এমনতেই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে৷’’

তার মতে, করোনার দুই বছর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু মানসিকভাবে তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে না৷

নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণণা দিয়ে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আমার কাছে বলেছে, তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছে পরিবারের চাপ৷ এত চাপ তাদের সামাল দেওয়ার মানসিক অবস্থা তো থাকতে হবে৷ ফলে হতাশা থেকেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে৷’’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বে সার্বিকভাবে মৃত্যুর ১৭তম প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা৷ অবশ্য ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ আত্মহত্যা৷ বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন৷ এ হিসেবে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন৷ যদিও দারিদ্র্য সরাসরি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িত নয়, তবে এটি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়৷ ডব্লিউএইচও'র এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যা করে তার ৭৭ শতাংশই হয়ে থাকে কম আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে৷

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, জন্মের পর থেকে জীবনধারনের দক্ষতা চর্চার বিষয় পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা উচিত৷ যোগব্যায়াম, মননশীলতার অনুশীলন, চাপ ব্যবস্থাপনা, রাগ ব্যবস্থাপনা, সহানুভূতি, নিজের যত্ন নেওয়ার মতো বিষয়গুলো থাকা উচিত৷

এই অধ্যাপক আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের ওপরও জোর দেন৷

তার মতে, মানুষ হতাশ হলে খুব ছোট কারণেও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না৷ তখন নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ এজন্য আশপাশের মানুষদের ব্যাপারে সবাইকে অনেক বেশি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে৷

শনিবার সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস৷ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার৷ এ লক্ষ্যে সামাজিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)৷ এতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা৷

গত চার বছরে আত্মহত্যা ঠেকাতে নানা সময়ে কাজ করতে দেখা গেছে জাতীয় জরুরি সেবা হটলাইন ৯৯৯-এর সদস্যদের৷ বিভিন্ন সময়ে ফোন পেয়ে তারা ছুটে গেছেন ভিকটিম উদ্ধারে৷

আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রণে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে: তানসেন রোজ

৯৯৯-এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘‘আমরা এই সময়ে দেড় হাজার আত্মহত্যা ঠেকিয়েছি৷ ৯৯৯ হচ্ছে জরুরি সেবা৷ আমাদের কাছে অনেক সময়ই আত্মহত্যা চেষ্টার তথ্য জানিয়ে কল এসে থাকে৷ অনেক সময় ভিকটিম নিজেই কল দিয়ে আমাদের কাছে জানান যে, তিনি পারিবারিক কিংবা কোনো খারাপ লাগার কারণে এই কাজ করছেন৷ এক্ষেত্রে আমরা কৌশলে তার অবস্থান জেনে নিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করে থাকি৷ এছাড়া অনেক সময় প্রতিবেশী কিংবা ভিকটিমের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কল দিয়ে আমাদের জানান৷ এক্ষেত্রে আমরা ভিকটিমের অবস্থান জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি৷’’

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমাজে যখন প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়, মানুষের মনে চাপ বাড়ে, জীবন ধারণের চাপ বাড়ে তখন আত্মহত্যা করে৷ কিন্তু আত্মহত্যাটা এক ধরনের অপরাধ৷ কারণ একটা জীবনকে শেষ করে দেওয়া আমাদের দেশের সমাজ ও আইন সেটাকে বৈধতা দেয়নি৷ আত্মহনন করলে পরিবার ও সমাজে একটি বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ এতে সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়৷’’

আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরে অধ্যাপক জিয়া বলেন, ‘‘পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না৷ প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যেন সংগ্রাম করতে না হয়৷ পারিবারিক বন্ধনটা যেন থাকে৷ কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে৷ সামাজিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না৷ খেলাধুলা, সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে সম্পৃক্ত থাকা, সৃজনশীল কাজে যত বেশি যুক্ত হওয়া যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য