1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মন্ত্রীর করোনা টিকার ফটোসেশন বিতর্ক ও ডিজিটাল শিক্ষা

মাজুল হাসান
১৯ মার্চ ২০২১

সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের করোনার টিকা নেয়ার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে৷ যেখানে তাকে টিকা নেয়ার ডামি পোজ দিতে দেখা গেছে৷

https://p.dw.com/p/3qqkO
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকছবি: M. Haque

সাথে সাথে বিরোধীরা সরব হয়েছেন৷ তাদের অভিযোগ, টিকা না নিয়ে কেবল ফটোসেশন করেছেন তিনি৷ অবশ্য এর ব্যাখা ও টিকা নেয়ার প্রমাণ হিসেবে প্রকৃত ভিডিও আপলোড করে মন্ত্রী সব বিতর্কের সফল জবাব দিয়েছেন৷ কিন্তু বিষয়টি বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে৷

প্রশ্ন হচ্ছে- একজন মন্ত্রী কেনো টিকা নেয়ার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে ডামি পোজ দেবেন? যখন শুরু থেকেই অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই টিকা নিয়ে একটি মিথ্যা প্রপাগান্ডা চলছে, যখন একটি মহল প্রচারণা চালাচ্ছে- ভারতে তৈরি এই টিকা কাজ করবে না, মন্ত্রী-এমপি-আমলারা এই টিকা নেবেন না, সাধারণ মানুষকে গিনিপিগ করে তারা নিচ্ছেন ফাইজার-বায়োঅ্যানটেক, মডার্না কিংবা জনসন এন্ড জনসনের মতো আরও ‘নিরাপদ ও কার্যকর’ টিকা৷ প্রধানমন্ত্রীকে জনসম্মুখে অক্সফোর্ডের টিকা নেয়া আহ্বানও হয়তো সেই ‘সন্দেহ’ কিংবা ‘প্রপাগান্ডা’র অংশ৷ এই যখন পরিস্থিতি তখন একজন ‘সাংবাদিকের’ অনুরোধে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর টিকা নেয়ার ফটোশ্যুট যে আলোচনার খোরাক যোগাবে সেটাই স্বাভাবিক৷ আসলে করোনা নিয়ে দেশে দেশে এমনকি অ্যামেরিকার মতো দেশেও বিভক্তি প্রবল৷ ট্রাম্পের এন্টিমাস্ক আর বাইডেনের মাস্ক ক্যাম্পেইন সেটাই প্রমাণ করে৷ আমাদের এখানে সেই রাজনৈতিক বিভক্তি আরও তীব্র, ফলে টিকার মতো একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়কে শেষ পর্যন্ত সন্দেহ-গুজবের ঘেরাটোপে পড়ে যেতে হয়েছে৷ এর জবাব দিতেই মন্ত্রী-এমপি বা বড় কর্মকর্তারা ক্যামেরার সামনে টিকা নিয়েছেন, নিচ্ছেন৷ বিষয়টা নিয়ে যখন আগের দিন মিডিয়া অফিসে প্রেস রিলিস আসে, তখন লেখা থাকে- কাল ওমুক হাসপাতালে ওমুক মন্ত্রী/এমপি/কর্তা টিকা নেবেন, একজন রিপোর্টার/ক্যামেরাম্যান পাঠিয়ে যেন কাভার করা হয়৷ সবাই চান তার টিকা নেয়ার ছবিটি যাতে প্রচার হয়৷ সবাই চান কাভারেজ, থাকতে চান মিডিয়ার লাইমলাইটে৷ এ এক নতুন বাস্তবতা৷

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেনো একজন মন্ত্রীর শরীরে সুঁই ফোটানোর ছবি লাগবে? এটা তো সেনসেটিভ ভিজ্যুয়াল৷ অনেকেই সুঁই ফোড়ার দৃশ্যে অসুস্থ বোধ করেন, যে কারণে অনেক টিভি স্টেশন এখন রক্ত ও মরদেহের ছবি প্রচার করে না৷ তাহলে এই ছবি লাগছে কেনো? কারণ দুটো৷ প্রথমত মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর আমজনতার আস্থাহীনতা, দ্বিতীয়ত: সেই সুযোগে তথাথিত সিটিজেন বা পার্টিজান জার্নালিজমের উত্থান৷ যদি সুঁচ ফোটানোর দৃশ্য না দেখানো হয় তাহলে আমজনতা বিশ্বাস করবে না৷ পারলে রক্ত বের হওয়া সম্ভব হলে সেটাও দেখাতে হয়! সেই কাজটিই করছে ইউটিউব চ্যানেল, ওয়েব, গ্রুপ, পেজগুলো- যার ব্রডার নাম নিউমিডিয়া৷ যে খবর দেশের মূলধারার প্রচারমাধ্যম প্রচার করে না বা পারে না, সেটা অবলীলায় নিউমিডিয়ায় আপ হয়েছে যায়৷ যাতে সত্য মিথ্যা, গুজব সব একাকার৷ এইসব চ্যানেলের অর্থপ্রাপ্তিও ঈর্ষনীয়৷ সেই হাতছানিতে দেশের টিভি স্টেশনগুলোও চ্যানেল খুলেছে, সেখানেও আলাদা করে এদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে৷ ফলে কোনো কোনো টিভি স্টেশন তাদের অনএয়ারে কিছু খবর প্রচার না করলেও সেগুলো নিউমিডিয়ায় আপ করছে৷ এজন্য রীতিমতো আলাদা কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে৷

এমনকি সাংবাদিকতার নীতিবর্জিত, রুচিবিরুদ্ধ টাইটেল, ইঙ্গিতপূর্ণ থাম্বনেইল ও কুতর্ক উস্কে দিতেও পিছপা হচ্ছেন না অনেকে৷ সবার চিন্তা শুধু ভিউ৷ ভিউ মানেই টাকা৷  এই ভিউ তথা পাবলিসিটির কাঙাল হয়ে পড়েছেন সবাই৷ এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি-বিরোধীনেতা-কর্মী৷ এই যখন অবস্থা তখন যে রিপোর্টার মন্ত্রীর টিকা নেয়ার ছবি পাননি তিনি মনে করছেন এখন কী হবে? আমার তো ছবি নাই, অন্য স্টেশন/পত্রিকা/চ্যানেল তো দেখিয়ে দেবে!

আবার আমরা যারা নিউজ রুম চালাই তারাও হয়তো বলব, ‘কি কর মিয়া ‘মানিশট'ই তো নাই, ঘাস কাটো!' এই ভিডিও ইউটিউবে দিলে কতো ভিউ হতো জানো? বেচারা সাংবাদিক এইসব ভেবে হয়তো মন্ত্রীকে অনুরোধ করলো- ডামি শট প্লিজ৷ কারো মনেই হলো না- এটা সংবাদ, নাটক-সিনেমা নয়৷ এখানে রি-টেকের সুযোগ নাই৷ যেই বেসিক আমাদের সাংবাদিকতায় শেখানো হয়-‘সময়, স্রোত আর সংবাদ কাহারও অপেক্ষায় বসিয়া থাকে না'৷ এখানে সাংবাদিকের অনুরোধে স্রোত ঘুরে পূর্বের অবস্থায় ফিরে এলো বা সাংবাদিকের মনে হলো স্রোতকে উল্টোপথে ঘোরানো যায়৷ কিন্তু এই যে প্রক্রিয়া তাতে যে বিরোধীরা ফায়দা নিতে পারে- সেটি কারোরই মনে হলো না৷ আবার সেই ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দানকারী ব্যক্তি যে ইভিল মোটিভ নিয়ে সব কিছু করেননি, সেটিও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না৷

যাই হোক, এটি ডিজিটাল-স্যোশাল মিডিয়ার যুগের নতুন বাস্তবতা৷ তাইতো টিকা নাও ও সেলফি পোস্ট করো- এমন ক্যাম্পেইন এখনও চলছে৷ এজন্য অনেকে কেন্দ্রে মাস্ক খুলে দাঁত কেলিয়ে সেলফি তুলছেন, স্বাস্থ্যকর্মী বা অন্যকে বলেছেন প্লিজ একটা ছবি তুলে দেন৷ টিকা যে একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়, মহামারির বিপরীতে এখন পর্যন্ত একমাত্র আশার আলো, সেটিকে নিয়ে যে রাজনীতির অবকাশ নেই- টিকা গ্রহণের মাধ্যমে সেই বার্তাই দেয়া যায়৷ যেমনটি করেছিল সিএনএন৷ এটা রিপাবলিকান নয়, এটা ডেমোক্র্যাট নয়, এটা শুধু মাস্ক- সেই বিবৃতি দিয়ে৷ এমন কোনো বিবৃতি বাংলাদেশের মূলস্রোতের কোনো গণমাধ্যম দিতে পারেনি, এটা দুঃখজনক৷

মাজুল হাসান, বার্তা সম্পাদক, যমুনা টেলিভিশন
মাজুল হাসান, বার্তা সম্পাদক, যমুনা টেলিভিশনছবি: privat

প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়েছে, সবার হাতে মুঠোফোন, ইন্টারনেট, তাতে নানা কনটেন্ট, সেখান থেকে গুজব ছেঁকে প্রকৃত সংবাদ বেছে নেয়া এক চ্যালেঞ্জ৷ অনেক শিক্ষিত মানুষকে দেখি এই ফারাক করতে পারেন না৷ নিত্যকর্মের নামে হাতে বিস্ফোরক গুঁজে দিয়ে কুচক্রীদের সটকে পড়া তারা ধরতে পারেন না৷ যেমনি বড় নেতাদের সাথে ছবি তুলে সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে এলাকায় দাপট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন অনেকে৷  নেতা জানেনই না তাকে বেচে দিয়েছে নব্যটাউট৷ এখানেই আসে ডিজিটাল লিটারেসি প্রসঙ্গ৷ এটি থাকলে, ডামি শ্যুটের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে মন্ত্রী বলতে পারতেন, যারা ছবি পেয়েছে তাদের কাছ থেকে কালেক্ট করে নাও৷ এখানে কার্টেসি-পাবলিসিটির খায়েসের জায়গা নেই৷ প্রয়োজন- ডিজিটাল লিটারেসি- যে দেখাচ্ছে, যাকে দেখানো হচ্ছে, যিনি দেখছেন- এটা সবপক্ষের৷

কিন্তু শঙ্কার কথা হলো, বাংলাদেশের অনেকেই তাদের পূর্বানুমান ও রাজনৈতিক মতাদর্শে এতটাই অন্ধ ও বিভক্ত যে তারা এই লিটারেসি অর্জন করতে পারছেন না বা চান না৷ সেই অন্ধত্ব, বিভক্তি ও লিটারেসিহীনতাকে আশ্রয়/পুঁজি করে ব্যবসা চলছে সবখানে৷ হোক সেটা রাজপ্রাসাদ, রাজপথ, মঞ্চ, বোকাবাক্স কিংবা অন্তর্জাল-ইন্টারনেট৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য