1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাঁচ বছরে বিএনপি কোথায়?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ নভেম্বর ২০১৮

১০ বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে৷ শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে নির্বাচনে না যাওয়ায় সংসদেরও বাইরে ছিল বিএনপি৷ কোনো আন্দোলন জমাতে পারেনি তারা৷ পাঁচ বছরের হিসেব-নিকেষে আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে বিএনপি?

https://p.dw.com/p/38R3b
Bangladesch Khaleda Zia
ছবি: bdnews24.com

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং সমমনা দলগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন বর্জনই করেনি, নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছিল৷ তাদের তখন দাবি ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে৷ বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করা তো দূরের কথা, কোনো কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি৷ বরং নির্বাচনের আগে ও পরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা ও আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, তার দায় পড়েছে দলটির ওপর৷তারপর এই দায় থেকে মুক্তি পেতে পার করতে হয়েছে পাঁচ বছর৷ ওই সন্ত্রাসের ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও বিএনপি সমালোচনার মুখে পড়েছে৷

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ছিল সংসদে বিরোধী দল৷ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে  মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল৷ আসন কম হোক, তবুও বিএনপি সংসদে ছিল৷ কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় একতরফা নির্বাচনের সুযোগ নেয় আওয়ামী লীগ৷ বিএনপি সংসদেরও বাইরে চলে যায়৷ আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে৷ ফলে  প্রায় একযুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি৷ এমনকি তারা সংসদেও নেই, যা বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে৷ দলের অনেক নেতা-কর্মী নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন৷ তবে গত পাঁচ বছরে বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে৷ আর তাতে তাদের অনেক প্রার্থী জয়ও পেয়েছেন৷ যদিও আইনি প্যাঁচে ফেলে তাঁদের অনেকের দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে৷

বিএনপি অবশ্য এই হতাশা আর নিস্ক্রিয়তার জন্য সরকারের দমন-পীড়নকে দায়ী করছে৷ তারা বলছে, শত শত মামলা, হামলা আর হয়রানি বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয়ার্ত করে তুলেছে৷ দীর্ঘদিন তাদের জনসভা তো দূরের কথা, কেথাও দাড়াতেই দেয়া হয়নি৷ দলটির দাবি, এজন্য পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছে সরকার৷

‘বুঝতে পেরেছে, এক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে দল চলে না’

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে৷ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনিও একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত৷এই দণ্ডপ্রাপ্তদের দলের নেতৃত্বে রাখার জন্য চলতি বছরে বিএনপি তার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে৷ কিন্তু সম্প্রতি হাইকোর্ট সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে৷ তবে বিএনপি'র আপিলের সুযোগ আছে৷

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন৷ ওইদিনই জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়৷ তবে সম্প্রতি দুদক-এর আপিলে সেই সাজার মেয়াদ বেড়ে ১০ বছর হয়েছে৷ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামের আরেক মামলায় তাঁর সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে৷ তারেক রহমান একুশে আগস্টের গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত৷ তিনি অর্থ পাচারের মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত৷

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাসের জের বিএনপিকে গত ৫ বছর ধরেই টানতে হয়েছে৷ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েকশ' মামলা হয়েছে৷ আর সম্প্রতি ‘গায়েবি' মামলা বলে যেসব মামলা হয়েছে, তাতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ আসামি৷ সর্বশেষ গত বৃধবার নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কমীদের যে সংঘর্ষ হয়েছে, তার দায়ও চাপছে বিএনপির ওপর৷ যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ‘‘সরকার পরিকল্পিতভাবে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে৷''

পাঁচ বছরে বিএনপি তার সংগঠনকেও গোছাতে পারেনি৷ স্থানীয় পর্যায়ে নতুন কমিটি হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে৷ কাউন্সিল হচ্ছে না৷ একবার হয়েছে খালেদা জিয়া মুক্ত থাকার সময়৷ তবে তা-ও ছিল নিয়ম রক্ষার কাউন্সিল৷ নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতার কাউন্সিল৷ ফলে শীর্ষ নেতৃত্বে যে সংকট, সেই সংকট এখন তৃণমূলেও৷ বিএনপিতে একটি কথা আছে যে, দলটি পরিচালিত হয় লন্ডন থেকে৷ তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই বিএনপি নেতাদের৷ আর এটাও শোনা যায় যে, ৫ ফেব্রয়ারির নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল তারই কথায়৷ নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত ছিল৷ কারণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল সুসংগঠিত হয়৷

বিএনপি এখন সেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে৷ শুরুতে তারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল৷ তবে সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এসেছে৷ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তাদের আছে৷ তবে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাচ্ছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে৷ এখন আর বিএনপি একা নয়৷ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে৷ ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন৷ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এখানে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে৷ কারণ, বিএনপিতে এখন তৃতীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন ছিল৷ ঐক্যফ্রন্ট সেই সংকট কাটাতে সহায়তা করেছে৷

ঐক্যফ্রন্টের নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এমন একটা সময় ছিল, যখন বিএনপির সবাই তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে থাকত৷ হুক্কা হুয়া করত৷ আমি সরকারকে ধন্যবাদ দিই যে, তারা খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে  সহায়তা করেছে৷ তারা বুঝতে পেরছে, এক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে দল চলে না৷''

‘পাঁচ বছরে দল ভাঙেনি – এটাই তাদের সাফল্য’

তিনি বলেন, ‘‘গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বিএনপির মধ্যে এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে৷ আমি তাদের কাছ থেকে জানি৷ আর এখন ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকেও দেখি৷ তারা সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়৷ কোনো এক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে না৷ দলের মধ্যে তারা গণতন্ত্র চর্চা শুরু করেছে৷ খালেদা জিয়াও তাদের গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন৷ ফলে নেতৃত্বের যে একটি সংকট তৈরি হয়েছিল, তা কেটে যাচ্ছে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি মনে করি, বিএনপির গত ৫ বছরে যদি কোনো অর্জন থাকে, সেটা এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট৷ এটা বিএনপিকে সাহস জুগিয়েছে৷ বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন বাইরে বের হতে সাহস পাচ্ছে৷ তারা মনে করছে, তারা এগিয়ে যেতে পারবে৷''

বিশ্লেষকদের মতে, ড. কামাল হোসেনকে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে আনা বিএনপির একটা বড় সাফল্য৷ এটা ভোটের হিসেব নয়৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি ধারা সৃষ্টির বিষয়৷ এখন দেখা যাক, এই ধারা ধরে রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি কোথায় যেতে পারে৷

বাংলাদেশে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়৷ এই বিচারের প্রশ্নে বিএনপি কখনো স্বচ্ছ অবস্থান নিতে পারেনি৷ গত পাঁচ বছরেও তার অবস্থান পরিষ্কার ছিল না৷ এটা হয়ত জামায়াত ও নিজ দলের যুদ্ধাপরাধীদের কারণে হয়েছে৷ আর জামায়াতকে পরিত্যাগের প্রশ্নেও বিএনপি আগের অবস্থানে আছে৷ ২০১৪ সালের সহিংসতা, সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের রায়ের পর সহিংসতায় জামায়াত ত্যাগের চাপ বিএনপির ওপর প্রবল হয়৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে কী অবস্থান নেয়, তা পর্যবেক্ষণ করছে৷ এরই মধ্যে বিএনপির মিত্র জামায়াতের দলীয় নিবন্ধন বাতিল হয়েছে৷ তারা প্রতীকও হারিয়েছে৷ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ও জামায়াত ইস্যু সামনে আসে৷ বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলেও তাদের ২০ দলীয় ঐক্যজোটে জামায়াত আছে৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোট এবং আদর্শিক কারণে বিএনপির পক্ষে জামায়াত-বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়৷ ফলে জামায়াত বিতর্ক বিএনপির পিছু ছাড়বে না৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার মনে করেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে দল হিসেবে বিএনপি যে ভেঙে যায়নি বা ভাঙা যায়নি – এটাই বিএনপির বড় সাফল্য৷ নানা সংকট ও ভুল সিদ্ধান্তের পরও বিএনপি ভেঙে কোনো কোনো উপদল বা আলাদা দল হয়নি৷ এটার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে৷ বাংলাদেশে ভোটের ভাগ দু'টি৷''

তিনি বলেন, ‘‘২০১৪-১৫ সালে বিএনপি ভুল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার দায় কিন্তু তারা স্বীকার করেনি৷ ফলে বলা যাবে না যে, বিএনপি ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে৷ তবে এবার নির্বাচনমুখী হয়েছে তার স্বার্থেই৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘জামায়াতকে ত্যাগ করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়৷ এটা শুধু ভোটের কারণে নয়, আদর্শিক কারণেও৷''

বিএনপি এবার নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে৷ আইন অনুযায়ী পরপর দু'বার কোনো নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়৷ বিএনপি সেটা জানে৷ আর নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা উজ্জ্বীবিত হয়৷ ১০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলটি এবার নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ আর সেই ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া-না-যাওয়ার বিষয় নেই৷ বিষয়টি দল হিসেবে বিএনপির এগিয়ে যাওয়া ও টিকে থাকার৷

প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো লিখুন নীচের ঘরে৷