1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গরিব দেশগুলো থেকে নারী পাচার বাড়ছেই

দেবারতি গুহ৪ ডিসেম্বর ২০০৮

সাধারণত, নারী ও শিশুদের অপহরণ করে অথবা নানা ধরনের ছলচাতুরি ও প্রলোভনের আশ্রয় নিয়ে পাচার করা হয়৷ নিয়োগ করা হয় অমানবিক সব কাজে৷ আর সেখানেই শেষ নয়৷

https://p.dw.com/p/G96P
নারী পাচারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক নারী সংবাদমাধ্যমকে তার কাহিনী জানাচ্ছেন ...ছবি: AP

পাচার হওয়া নারী বা শিশু যদি ফিরে আসে - তাহলেও বিভিন্ন রকম সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয় তারা৷ কারণ, তখন তারা আর মানুষ নয়, পরিণত হয়েছে ভিক্টিমে !

এই নারী পাচার রোধে বিশ্বব্যাপী নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু, তারপরও এই আদম ব্যবসাকে ঠেকানো যায় নি৷ বরং বিশ্বায়ন এবং মুক্ত অর্থনীতির সংস্পর্শে এসে নারী পাচার পরেছে নতুন মুখোশ৷ পেয়েছে নতুন নাম৷

সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে নারী পাচার প্রধানত এশিয়ার গরিব দেশগুলিতেই হয়ে থাকে৷ ভারত-বাংলাদেশ তো বটেই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কাম্বোডিয়াতেও নারী পাচারের ঘটনা নতুন নয়৷ কাম্বোডিয়াতে নারী পাচারের বিরুদ্ধে বহুদিন যাবত লড়াই করছেন বিশিষ্ট নারীবাদি কর্মী সোমালি মাম৷ গত ২৪-শে নভেম্বর, জার্মান সরকারের কাছ থেকে রোন্যাল্ড বেরগার মানবাধিকার পুরস্কারটি নিতে বার্লিনে এসেছিলেন সোমালি মাম৷

সোমালি জানান, আমি এর আগেও বহু পুরস্কার পেয়েছি৷ কিন্তু, কোন পুরস্কারই আমাকে এতোটা আনন্দ দেয় নি৷ ওরা যখন আমাকে ফোন করে বলেছিল আমি পাচারকৃত নারীদের ওপর কাজ করার জন্য এই পুরস্কার পাচ্ছি, তখন আমি সংগঠকদের বলেছিলাম - আমি সেই নারীদেরই একজন৷ বলেছিলাম, যে আমি আমার মাকে দেখি নি৷ বাবাকেও না৷ সোমালি আমার অসল নাম কিনা - সে বিষয়েও আমার কাছে স্পষ্ট কোন প্রমাণ নেই৷

ইতিমধ্যেই, কাম্বোডিয়ায় নারী পাচার বিরোধী একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন সোমালি মাম৷ প্রান্তিক নারী ও শিশুদের সাহায্য করা, তাদের পতিতাবৃত্তির হাত থেকে রক্ষা করা, তাদের অধিকার নিশ্চিত করাই নির্যাতিত নারী ত্রাণ সংস্থা বা এএফইএসআইপি নামের এই সংগঠনের প্রধান কাজ৷ আর সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই সোমালি মাম-কে এই পুরস্কারে ভূষিত করেছে জার্মানি৷ যার অর্থমূল্য - এক মিলিয়ন ইউরো৷ বার্লিনে সোমালি মামের হাতে পুরস্কার তুলে দেন জার্মান প্রেসিডেন্ট হর্স্ট ক্যোলার স্বয়ং৷

ক্যোলার বলেন, নারী এবং শিশুদের পতিতাবৃত্তি, যৌন পর্যটন এবং ব্যবসার অন্ধকার জগৎ থেকে দূরে রাখতে দীর্ঘদিন লড়াই করছেন সোমালি মাম৷ যাঁর জীবনকাহিনী শুনলে একদিকে যেমন সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তেমনই আশার আলোও জাগায়৷ মানবাধিকার রক্ষায় তিনি অবশ্যই আমাদের সামনে এক উদাহরণ৷

সত্যি, এশিয়ার যৌন মাফিয়ার বিপক্ষে তাঁর লড়াই এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন ৩৮ বছর বয়সী সোমালি৷ অদম্য সাহস আর উদ্যম নিয়ে৷ তাঁর সংস্থাটিতে পাচারকৃত নারীদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাও করেছেন সোমালি৷ এমনকি জার্মান সরকার প্রদত্ত রোন্যাল্ড বেরগার পুরস্কারটিও সেই নির্যাতিত নারীদের সঙ্গেই ভাগ করে নিতে চান সোমালি৷

তিনি বলেন, আমাদের কেন্দ্রগুলিতে আশ্রয় নেওয়া সব নির্যাতিত মেয়েদের সঙ্গে আমি এই পুরস্কার ভাগ করে নিতে চাই৷ তারাই আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে, ভালোবাসা দিয়েছে৷ অল্প বয়েসে আমি যা কিছু পাই নি - তার সব কিছুই তারা আমাকে দিয়েছে৷ এদের কারো বয়েস ৫,৬ অথবা ৭৷ অনেকের দেহেই এইডস রোগ বাসা বেঁধেছে৷ এরা স্কুলে যায়, দিনে ৩ বার ওষুধ খায়৷ তাদের ভেতরে কি অসাধারণ মনোবল !

অথচ, এখনও নারী পাচার বন্ধ হয়নি৷ পাচার চলছে৷ চলছে পাচারের সঙ্গে যুক্ত পতিতাবৃত্তি, যৌন পর্যটন, বিভিন্ন বাধ্যতামূলক শ্রম৷ চলছে নারীদের রক্ষিতা, ক্রীতদাস বা যৌন ছায়াছবি বা পত্রপত্রিকায় নগ্ন মডেল হিসেবে ব্যবহারের ঘৃণ্য কাজ৷ কেন ? জার্মান প্রেসিডেন্ট তুলে ধরলেন তার একটি অন্যতম কারণ৷

ক্যোলার-এর কথায়, আমার লজ্জা হয়, যখন দেখি আমাদেরই দেশের মানুষরা সারা দুনিয়ায় নারী ও শিশুদের ওপর যৌন পীড়নে অংশ নিচ্ছে৷ হাজার হাজার মেয়েদের গণিকাবৃত্তির কাজে লাগানোর জন্য আমাদের দেশে পাচার করা হচ্ছে৷ এটাও এক জঘন্য লজ্জার ব্যপার৷

প্রতি বছরই ভারত-বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য নারীকে পাচার করা হয়ে থাকে৷ বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ নারী পাচার হয়ে বিদেশে যান, তার সিংহভাগকে জোর করে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়৷ আর তার বেশিরভাগই পাচার হয় ভারতে৷ পশ্চিমবঙ্গের নারী ও সমাজ কল্যাণ দপ্তর জানাচ্ছে, যে রাজ্যে নারী পাচারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এবং অধিকাংশ পাচারের দালালচক্র কলকাতা মহানগরী এবং শহরতলীতে সক্রিয় রয়েছে ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে, যে দেহব্যবসার জন্য ৩৫-টি শহরে যে সংখ্যক মেয়ে বিক্রি হয়, তার ৫০ শতাংশই হয় কলকাতায়৷ আর যে সংখ্যক মেয়ে কেনা হয়, তার মধ্যে ৪৭.৪ শতাংশ কেনা হয় কলকাতায়৷ এছাড়াও, নাবালিকা মেয়েদের পাচারের প্রায় ৪৫.৫ শতাংশই চলে জোব চার্নকের এই শহরের সীমানার ভিতর৷

বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা একেকজন নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি করে৷ এদের মধ্যে আবার অনেকেই কিশোরী৷ পতিতালয়ে স্বাভাবিকভাবেই, নারীরা মানসিক ও শারিরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ অস্বীকৃতি জানালে ঘরে বন্ধ করে রাখা, এমনকি অ্যাসিড দিয়ে শরীরের অংশ বিশেষ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও নিতান্ত ব্যতিক্রম নয়৷ অনেকে আবার অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভধারণও করে৷ আবার অনেকে, আক্রান্ত হয় এইডস রোগে৷ তেমনটি হলে, তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়৷

সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে কলকাতায় প্রায় ২১-টি যৌনপল্লী আছে৷ তবে সব মেয়ে যে ‘পাচার' হয়ে যৌনপল্লীতে ঠাঁই পাচ্ছেন তা নয়৷ অনেকেই যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিচ্ছেন আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে৷ অনেক ক্ষেত্রে আবার পাচার হয়ে আসা মহিলারা তথাকথিত পুনর্বাসনের পরেও, যৌনপল্লীতে ফিরে যান৷ দারিদ্র্যই তাদের ঠেলে দেয় পুরনো পেশায়৷