1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাভাষার সংকট

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২

বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের স্মরণ করি৷ তাঁদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই৷

https://p.dw.com/p/146KW
Ekushey
Amar Ekushey Buch Messe Dhaka Bangladesch 2012ছবি: DW

শীতার্ত মানুষের যেমন প্রয়োজন হয় অগ্নিকুণ্ডের, সংকটাপন্ন মুক্তিকামী বাঙালিরও তেমনি প্রয়োজন হয় একুশে ফেব্রুয়ারির কাছে যাওয়ার৷ ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা৷ স্বাধীন হওয়ার পরও বাঙালির জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রয়োজন একটুকু ম্লান হয়ে যায়নি৷ প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি বিজয়ে বাঙালি বারবার ছুটে যায় একুশের শহীদ মিনারে৷ উত্তাপ গ্রহণ করে উজ্জীবনের, উজ্জীবিত হওয়ার৷

একুশে ফেব্রুয়ারি কি শুধুই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম ছিল? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়৷ সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত রাজনৈতিক চেতনায় সৃষ্ট যে রাষ্ট্র পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা পেয়েছিল – সে রাষ্ট্রের প্রগতিবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র স্পষ্ট হতে সময় লাগেনি৷ সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য আক্রমণটা প্রথমে আসে বাংলাভাষার ওপরে৷ এটা ছিল হিসাবকষা আক্রমণ৷

নতুন পাওয়া রাষ্ট্রে শিক্ষাদীক্ষায় পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলা৷ তাই তাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা৷ বাংলা হবে উচ্চশিক্ষার বাহন৷ অফিস-আদালতে চলবে বাংলা৷

Flash-Galerie Internationaler Tag der Muttersprache
‘এখন আর ‘আ মরি বাংলাভাষা' নয়, এখন চলছে ‘আয় মারি বাংলাভাষা'ছবি: picture-alliance/dpa

সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের রাজার মতো পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী সামন্তশ্রেণিও মনে করত, যারা যত বেশি জানে, তারা তত কম মানে৷ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠলে তাদের আসন টলে উঠবে এই আশংকায় তারা প্রথমেই বাংলাভাষাকে আঘাত করলো৷

বাংলাভাষাকে রক্ষার সরাসরি সংগ্রাম প্রথম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে৷ প্রাথমিক ধাক্কা খাওয়ার পর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা এরপর শুরু করে বাংলাভাষাকে বিশৃঙ্খল করে তাকে দুর্বল করে ফেলার প্রয়াস৷ একদিকে শুরু হয় আরবি হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা৷ অন্যদিকে, একদল লেখক বাংলাভাষা থেকে তথাকথিত বিধর্মী সংস্কৃত শব্দকে বিতাড়ন করে তার বদলে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ দিয়ে তৈরি মুসলমানি বাংলা নামে এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিল – যা এককালে প্রচলিত ছিল বটতলার পুঁথিতে৷ বলাবাহুল্য, এসব কিছুই ছিল পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের শোষণ ব্যবস্থার অপকৌশল৷ তারা চেয়েছিল বাংলাভাষা যেন কিছুতেই জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চার যোগ্য বাহন হয়ে উঠতে না পারে৷

এর প্রতিবাদ হিসেবেই এলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি৷ অমর একুশের শহীদদের রক্তদানে বাংলাভাষাই যে কেবল সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলো তা নয়, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করল আধুনিক, প্রগতিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক৷ পূর্ববঙ্গের বাঙালির চিন্তাজগতে লাগল হঠাৎ আলোর ঝলকানি৷ বাঙালি হয়ে উঠল প্রতিবাদী৷ এই প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি পেলো স্বাধীনতা – স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ – যে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা৷

Bonn International Mother Language Day Flash-Galerie
‘একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শহীদ দিবস নয়, শুধুই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ছবি: DW

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর প্রত্যাশা করা হয়েছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষায় বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চতর শিক্ষা সহজ ও বোধগম্য করে তোলা হবে৷ এ চেষ্টা শুরু করাও হয়৷ তবে প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক৷ অফিস আদালতে বাংলা প্রচলনের ধীরগতিতে বিরক্ত বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চে জারি করা এক পরিপত্রে লেখেন, ‘‘মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷''

বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পরে ঘটে বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন৷ পরিবর্তন শুধু রাজনীতিতে নয়, সর্বত্রই ঘটে৷ স্বাধীনতার পরে যে নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে হঠাৎ তারা অস্বাভাবিক দ্রুততায় অগ্রসর ও একত্র হতে শুরু করে৷ এর পরে তাতে যুক্ত হয় নতুন এক মাত্রা – তার নাম বিশ্বায়ন৷ এর মাধ্যমে এককালের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী সামন্তবাদ রূপান্তরিত হয় আধুনিকতার খোলসে মোড়া দুর্ধর্ষ বেনিয়া পুঁজিবাদে৷ শুধু পুঁজিবাজার নয়, এরা দখল করতে শুরু করে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ক্ষেত্রগুলো৷ এরা তৈরি করতে শুরু করে তাদের কাজে আসবে এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তাদের কাজে লাগবে এমন সব রেডিয়ো ও টেলিভিশন চ্যানেল৷

এদের গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাভাষা ব্রাত্য৷ এদের তৈরি প্রচারমাধ্যমে বাংলাভাষা বিকৃত৷ এরা একুশে ফেব্রুয়ারি বললেও পরের দিনটাকে বলে বাইশ ফেব্রুয়ারি৷ এরা বড় বেশি আন্তর্জাতিক৷ এদের প্রচারমাধ্যমের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শহীদ দিবস নয়, শুধুই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস৷ এদের প্রচারমাধ্যমের উপস্থাপক ও নাটকের চরিত্রের মুখে যুগপৎ ইংরেজি আর আঞ্চলিক বাংলার খই ফোটে৷ জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাভাষার যে রীতিটাকে আমাদের প্রাজ্ঞজনেরা প্রমিত ভাষা নাম দিয়েছিলেন, ইদানিং দেখা যাচ্ছে অনেক তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন৷ এঁদের মতে প্রমিত ভাষা কৃত্রিম তাই তাঁরা লিখতে চান তাঁদের প্রিয় বর্তমান তরুন প্রজন্ম আর নিম্নবর্গের মানুষের ভাষায়৷ এঁদের কাছে বাংলা শুধুই মনের ভাবপ্রকাশের ভাষা অর্থাৎ নাটক, উপন্যাস আর কবিতা লেখার ভাষা, জ্ঞানচর্চার ভাষা নয়৷

বাংলাভাষা যেন শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট সুশৃঙ্খল, দৃঢ় ও শক্তিশালী না হয়ে উঠতে পারে সেজন্য একদা পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বাংলাভাষাকে অযথা আরবি, ফারসি আর উর্দুতে ভরিয়ে দিয়েছিল৷ সেই প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিকতার লেবাসে পুনরায় যেন ফিরে আসছে৷ এরা চায় না নিম্নবর্গের মানুষ উপরে উঠে আসুক৷ বিশুদ্ধ ভাষার শক্তিকে এদের বড় ভয়৷ তাই তাঁরা মুখের ভাষার নামে বাংলাভাষাকে বিশৃঙ্খল করে দিতে চায় সচেতনভাবে৷

বাংলাভাষার এই পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টির প্রয়াস দেখে প্রবীণ ভাষাতত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদ রফিকুল ইসলাম বলতে বাধ্য হয়েছেন, এখন আর ‘আ মরি বাংলাভাষা' নয়, এখন চলছে ‘আয় মারি বাংলাভাষা'৷ অন্যদিকে নবীন শিক্ষাবিদ ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, বাংলাভাষার এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষতে আরেকবার ভাষা আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে উঠবে৷

প্রতিবেদন: ফরহাদ খান

সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান