1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

৮০ বছর পূর্ণ করতে চলেছেন সুচিত্রা সেন

৪ এপ্রিল ২০১১

বাংলা ছায়াছবির জগতে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা বোধ হয় সুচিত্রা সেন৷ প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’৷ শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’৷ আগামী ৬ এপ্রিল কিংবদন্তী সেই নায়িকার ৮০ জন্মবর্ষ পূর্তি৷

https://p.dw.com/p/10myD
ছবি: DW

‘নামে কিবা এসে যায়' - এই প্রবাদ সঠিক নয় সর্বদা৷ বিশেষতঃ, নাটকে-সিনেমায়৷ নায়ক-নায়িকার নাম হবে ওজনদার, দর্শকের চিত্ত বিলোড়িত করবে, অন্তত ষাটের দশকে৷ এই যেমন, উত্তমকুমারের আসল নাম কী - তা অনেকেরই অজানা৷  

নামে অবশ্যই কৌলিন্য দরকার৷ ছিলেন রমা দাশগুপ্ত৷ হয়ে গেলেন সুচিত্রা সেন৷ প্রথম ছবি ১৯৫২ সনে৷ সেই ছবি ‘শেষ কোথায়'-এ রমা দাশগুপ্ত নামেই অভিনয় করেছিলেন তিনি৷ ছবিটা অবশ্য কোনোদিনই মুক্তি পায় নি৷

গুজব তথা গুঞ্জরণ এই যে, অভিনয়ের জন্য নিজেই ‘সুচিত্রা' নামটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এ কথা হয়তো ঠিক নয়৷ সুচিত্রার নিজের কথায়, ‘‘আমাদের এক আত্মীয় সুকুমার দাশগুপ্তই আমার ‘সুচিত্রা' নামকরণ করেন৷'' কারণও ছিল৷ সুকুমার দাশগুপ্ত তৈরি করেন ‘সাত নম্বর কয়েদী' নামে একটি ছবি (১৯৫৩)৷ সেখানে নায়িকা রমা নয়, সুচিত্রা৷ স্বামী দিবানাথের পদবী সেন-ও যোগ করা হয়৷ ছবির নায়ক ছিলেন সমর রায়৷ ছবিটি রীতিমতন ফ্লপ৷ রমা বলেন, ‘‘ফ্লপ হলেও সুচিত্রা নামটাই বেছে নেই৷''

সুচিত্রা কেন আমাকে এ কথা বলেছেন - তা নিয়ে কৌতূহল হতেই পারে পাঠকের৷ ঘটনা এমন আহামরি নয়৷ ওঁর কন্যা মুনমুন আমার বন্ধু৷ সহপাঠিনী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্যে৷ সেই সুবাদে, সহপাঠি ও সহপাঠিনীরা মুনমুনের বাড়িতে কতো দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা গুলজার করেছি, ইয়ত্তা নেই৷

তবে আরো কারণ আছে বৈ কী ! বালিগঞ্জে মুনমুন আর আমার আস্তানার দূরত্ব সাকুল্যে ২০০ মিটারও হবে না৷ এও হয়তো বাহ্য৷ প্রসঙ্গক্রমে মুনমুন কখনো-বা বলে থাকবেন মাকে যে, আমার বাড়ি পাবনা৷ পাবনার কোথায় ? সুচিত্রা সেন নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন একদিন৷ বলি, ‘‘শহরে, দিলালপুরে৷ আপনাদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির সীমান্ত পেয়ারা গাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছে ঘেরা ছিল, অন্তত তখন৷ এখনো আছে৷ আপনাদের বাড়ি একতলা৷ এক বিঘে জমির ওপর৷ আর আমাদের বাড়ি ছিল দোতলা৷'' স্মৃতি ঝলসিয়ে সুচিত্রা বললেন, ‘‘ওই বাড়ির রিজিয়া আমার সঙ্গে পড়তো৷'' আমি বললুম, ‘‘তিনি আমার বড় আপা৷''

সুচিত্রা সেনের জন্ম ৬ এপ্রিল ১৯৩১৷ দিলালপুরে নয়, পাবনার সিরাজগঞ্জের (এখন জেলা) বেলকুচির (এখন উপজেলা) সেনডাঙার জমিদার বাড়িতে৷ সুচিত্রার মাতৃমহ ছিলেন ছোটখাটো জমিদার৷ বাবা - করুণাময় দাশগুপ্ত৷ মা - ইন্দিরা দাশগুপ্ত৷ বাবা দিলালপুরের একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন৷ আর মায়ের দায় ছিল ঘরকন্নার৷ করুণাময়-ইন্দিরা দাশগুপ্তর পাঁচ সন্তানের তৃতীয় ছিলেন রমা দাশগুপ্ত, আমাদের সুচিত্রা সেন৷

গোটা পাবনা জেলায় তখন একটিই সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, সেই দিলালপুরেই৷ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত (অসমাপ্ত) পড়েছেন রমা দাশগুপ্ত৷ এইখানেই পাঠককে জানিয়ে রাখি, সুচিত্রার শ্বশুরের পিতামহ ছিলেন দীননাথ সেন৷ তাঁর নামে পুরোনো ঢাকায় একটি রাস্তা এখনো বহাল তবিয়তে৷ আর কলকাতায় আদিনাথ সেনের ব্যারিস্টার-ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে রমার বিয়ে হয় ১৯৪৭-এর অক্টোবরে৷

দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' (১৯৫৩, নায়ক বসন্ত চৌধুরী)৷ ছবিতে অভিনয় করে ঢেউ তোলেন সুচিত্রা৷ পরবর্তী ছবি, একই বছরে, ‘সাড়ে চুয়াত্তর'৷ পরিচালক নির্মল দে৷ নায়ক উত্তমকুমার৷ রমরমা৷ প্রচণ্ড হিট৷ কিন্তু, সুচিত্রা-উত্তম জুটির সেই ম্যাজিক তখনও শুরু হয়নি৷ অগ্রদূত পরিচালিত ‘অগ্নিপরীক্ষা' (১৯৫৪)-য় অভিনয় করে সুচিত্রা-উত্তম জুটি পোক্ত হয়ে যায়৷ যদিও সমর রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, রবীন মজুমদার, প্রশান্তকুমার, অসিতবরণ, উৎপল দত্ত, রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন৷ কিন্তু জুটি বলতে উত্তমের সঙ্গেই৷

হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে মোট ৬০টি ছবিতে অভিনয় করেন কিংবদন্তী সেই নায়িকা৷ হিন্দি ছবিতে অশোককুমার, দিলীপকুমার, দেবানন্দ, সঞ্জিবকুমার, ধর্মেন্দ্র প্রমুখের সঙ্গে অভিনয় করেছিন৷ অনেকের মতে, ইচ্ছে করলেই তিনি বলিউডের সম্রাজ্ঞীও হতে পারতেন৷ কেন হন নি, জিজ্ঞেস করিনি৷

উত্তমের সঙ্গে নয়, সৌমিত্র'এর বিপরীতে ‘সাত পাকে বাঁধা' (১৯৬৩, পরিচালক অজয় কর)-য় অভিনয় করে, মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপায় সম্মানিত হন সুচিত্রা৷ এছাড়াও, পান দাদাসাহেব ফালকে, রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার৷ তবে কোনো পুরস্কারই তিনি নিজে নিতে যাননি৷ তাঁর হয়ে কন্যা মুনমুন নিয়েছেন পুরস্কারগুলি৷ ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে মনোনীত করা হলেও, কেন বঞ্চিত করা হয় শেষ অবধি - সে রহস্য আজও অজানা৷ অবশ্য, সুচিত্রার জন্য এ ধরনের পুরস্কার আদৌ কোনো ব্যাপার নয়৷

সত্যজিৎ রায় একবার আমাকে বলেন, ‘‘দেবী চৌধুরানীর স্ক্রিপ্ট সম্পূর্ণ তৈরি৷ অভিনেতা-অভিনেত্রীও নির্বাচিত৷ সুচিত্রাই নায়িকা৷ ওঁকেই মানায়৷ কিন্তু, ব্যস্ততার ফলে এক বছরেও সময় দিতে পারেন নি তিনি ৷ তাই বাদ দিয়ে দেই ছবি৷''

সুচিত্রার বয়ান অবশ্য ভিন্ন৷ বলেন, ‘‘মানিকবাবু (সত্যজিৎ রায়)-র আমাকে দেখেই প্রথম কথা - আপনাকে গড়েপিঠে মানুষ করতে হবে৷ শুনে অপমানিত বোধ করি৷'' পরবর্তীতে, দীনেন গুপ্ত পরিচালিত দেবী চৌধুরানী (১৯৭৪, নায়ক রঞ্জিত মল্লিক)-র ভূমিকায় সুচিত্রা সেনের অভিনয় বঙ্কিমের গোটা উপন্যাসটিকেই যেন ম্লান করে দেয়৷

তবে দুই-তিনটি চরিত্রের বিচারে সুচিত্রা বিচার্য নন৷ সামগ্রিক সবকিছু মিলিয়েই সুচিত্রা সেন৷ তিনি কিংবদন্তী৷ চিত্তহরণকারিণী৷ ৮০ জন্মবর্ষে তাঁকে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা৷

প্রতিবেদন: দাউদ হায়দার, বার্লিন

সম্পাদনা: দেবারতি গুহ