1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাতের কলকাতা নিরাপদ নয়

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা২২ জুলাই ২০১৩

ধর্ষণ, নিগ্রহ বা শ্লীলতাহানির ঘটনার জন্য কামদুনি বা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো অজপাড়াগা অথবা মফস্বলের কোনো নাম না জানা শহরে যেতে হবে কেন? হাতের কাছেই তো রয়েছে শ্বাপদসংকুল এক জঙ্গল, যার নাম কলকাতা!

https://p.dw.com/p/19B9e
ছবি: Fotolia/DW

শনিবার রাত দুটো৷ এক পুরুষ আর এক মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন৷ হঠাৎই পিছন থেকে তাঁদের প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়ল মোটরবাইকে সওয়ার দুই যুবক৷ পিছনে বসা ছেলেটি হেঁকে কিছু বলছে৷ কান পেতে শুনে বোঝা গেল, নেশাগ্রস্থ জড়ানো গলায় সে ওই অপরিচিত তরুণী মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করছে৷ আর অতি অবশ্যই সেটা এত মার্জিত ভাষায় বা পরিশীলিত ভঙ্গিতে নয়৷ হাবেভাবে এবং ভাষায় যতটা কুৎসিত আর অপমানজনক হওয়া সম্ভব, তার থেকে বেশিই অশালীন ও বেপরোয়া হতে চাইছে সে৷

কিন্তু আরও বড় আতঙ্ক অপেক্ষায় ছিল মেয়েটির জন্য, যখন শরীরের ক্ষিদে মেটানোর জান্তব চাহিদা নিয়ে ওই দুই যুবক এবং তাদের আরও দুই সঙ্গী তরুণীকে তাড়া করল৷ বেঁচে যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটি ও তাঁর সঙ্গীর উপস্থিতবুদ্ধি সেই রাতে ওঁদের অবিশ্বাস্যভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে নিশ্চিত ধর্ষণ এবং সম্ভাব্য প্রাণহানির হাত থেকে৷ এবং এই ঘটনা কিন্তু প্রহরাহীন নির্জন মফস্বল এলাকা কামদুনিতে ঘটেনি, ঘটেছে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত যোধপুর পার্ক-লেক গার্ডেন্স এলাকায়৷

Symbolbild sexuelle Gewalt Prostitution Menschenhandel Zwangsprostitution
রাতের কলকাতা আর একেবারেই নিরাপদ নয়ছবি: picture alliance / Photoshot

সেই রাতের আক্রান্ত ওই তরুণী ২২ বছরের এক ফরাসি নাগরিক৷ তিন মাসের জন্য তিনি কলকাতায় এসেছিলেন অলিয়স ফ্রঁসে-তে শিক্ষানবীশ কর্মী হিসেবে৷ ১৪ জুলাই ফ্রান্সের জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে, আগের দিন অলিয়স ফ্রঁসে-তে একটি অনুষ্ঠান ছিল৷ রাত সাড়ে দশটায় সেই অনুষ্ঠান শেষ হয়, যার পর গড়িয়াহাটে এক বন্ধুর বাড়িতে ওই তরুণী গল্প করতে যান৷ সেখানে আড্ডা শেষ হয় রাত দুটো নাগাদ, এবং অলিয়স ফ্রঁসেরই এক সহকর্মী, যিনি নিজেও ফরাসি, মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে ট্যাক্সি করে যোধপুর পার্ক যান৷ তখনই ঘটে ওই ঘটনা৷ আক্রান্ত হওয়ার পর দুই মদ্যপ যুবককে কথার ছলে আটকে রেখেছিলেন ওই ফরাসি যুবক, এবং নিজেদের ভাষায়, অর্থাৎ ফরাসিতে ওই তরুণীকে বলেছিলেন গা ঢাকা দিতে৷ ফলে মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে এলাকার একটি আবাসনের গেট টপকে ভিতরে ঢুকে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান৷ কিন্তু তার পর, শহর কলকাতার লজ্জা বাড়িয়ে ওই ফরাসি তরুণী পরের দিনই দেশে ফিরে গিয়েছেন৷ তাঁর হয়ে তাঁর ওই সঙ্গী পুরুষটি পরদিন থানায় অভিযোগ জানাতে যান৷ সেখানে পুলিশ তাঁকে নানা প্রশ্নের মধ্যে এটাও জিজ্ঞেস করে যে মেয়েটি কেমন ধরনের পোশাক পরে ছিল!

এই ঘটনার পর কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী বিদেশিনীরা অনেকেই একটু ত্রস্ত৷ তবে ওঁরা প্রায় সবাই বলেছেন, কলকাতাকে আলাদা করে বেছে নেওয়ার কোনও কারণ নেই৷ তবে ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক শহরই এখন আর গভীর রাতে নিরাপদ নয়৷ বিশেষ করে উত্তর ভারতে, দিল্লি বা নয়ডায় বসবাস করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, সেই মহিলারা এক বাক্যে বললেন, কলকাতা সেই তুলনায় অনেক নিরাপদ৷ কিন্তু একটা নিয়ম সব শহরেই মেনে চলা উচিত, যে অযথা অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে পরিচিত পরিধির বাইরে বেশি এদিক ওদিক না যাওয়া৷ বললেন দেবত্রি, যিনি দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন ইটালির একটি এনজিও-র সঙ্গে এবং প্রায়ই বিদেশ থেকে তাদের ভলান্টিয়াররা কলকাতায় থাকতে আসতেন৷ এই ভলান্টিয়াররা, যাঁদের বেশিরভাগই মহিলা এবং কমবয়সি, কাজের প্রয়োজনে এঁদের প্রায় রোজই শহরের বাইরে, গ্রাম-মফস্বল এলাকাতে যেতে হয়৷

Symbolbild Vergewaltigung
বিদেশিরা রেহাই পাচ্ছেন না নির্যাতনের হাত থেকেছবি: picture-alliance/dpa

দেবত্রি বলছেন, ওই বিদেশিনীদের একটা কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, পরিচিত এলাকা মানে নিরাপদ এলাকা৷ যেসব লোকের সঙ্গে রোজ দেখা হচ্ছে, তাঁদের পরিচিত যারা, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ-পরিচয় হয়েছে, তাঁদের থেকে বিপদের সম্ভাবনা কম৷ সেই চেনাশোনার বৃত্তের বাইরে যাওয়াই উচিত নয়৷ যদি যেতেই হয়, তাহলে কখনই একা নয় বরং দল বেঁধে যাওয়া উচিত৷ আর শহরে সামাজিক মেলামেশার ব্যাপারেও দেখা গেল একই নিয়ম মেনে চলেন অ্যামেরিকা থেকে আসা হেদার৷ ৩২ বছরের হেদার যুক্ত আছেন শহরের এক নামি বেসরকারি হাসপাতালের একটি প্রকল্পের সঙ্গে, গত দেড় বছর হলো কলকাতার অস্থায়ী বাসিন্দা৷ তিনি বললেন, দক্ষিণ কলকাতার যে পাড়ায় তিনি পেয়িং গেস্ট থাকেন, সেখানেও সচরাচর একা চলাফেরা করেন না৷ তার কারণ, এটা হেদারের অভিজ্ঞতা যে, কলকাতার মানুষজন একটু বেশিই আলাপী৷ এদের অধিকাংশই আসলে খুব ভালো মানুষ, কিন্তু কিছু লোকের তো অসদুদ্দেশ্যও থাকে! যে কারণে ওঁরা সবাইকেই এড়িয়ে চলেন৷

এ ব্যাপারে খুব কঠোর নিয়ম মেনে চলেন অ্যামেরিকার মেয়ে কোর্টনি স্টিফেনস৷ ১৯৯৪ সালে কোর্টনি প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন বেড়াতে৷ বছর দুয়েক আগে একটি তথ্যচিত্র তৈরির সূত্রে আবার তিনি কলকাতায় আসেন এবং বেশ কিছু মাস এই শহরের বাসিন্দা হয়ে ছিলেন৷ তারপর থেকে তাঁর কলকাতায় যাতায়াত লেগেই আছে, কিন্তু কোনোদিন কোনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি তাঁকে৷ তার একটাই কারণ, কোর্টনির কঠোর নিয়ম ছিল নিজের জন্যে, ‘নো লেট নাইট, নো পার্টি'৷ প্রথমবার ভারত ভ্রমণে এসেই কোর্টনি টের পেয়েছিলেন, মেয়েদের ব্যাপারে এই দেশের পুরুষদের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়৷ সেটা নির্দোষ কৌতূহল থেকে ধর্ষণের বাসনা, বা নেহাতই শারীরিক নিগ্রহ করে মজা লোটার প্রবৃত্তি, অনেক কিছুই হতে পারে৷ ফলে লেট নাইট পার্টির মজাটা নিজের দেশের জন্যেই তুলে রাখেন কোর্টনি৷ তবে কেউ যদি সেটা করতে চায়, তার মানেই এই নয় যে তার জন্য কোনও মেয়েকে বিকৃতকাম পুরুষদের লালসার শিকার হতে হবে৷ কলকাতার মতো আধুনিকমনস্ক শহরের কাছে সেটা প্রত্যাশিত নয়, কোর্টনির সাফ কথা!

Symbolbild Kriminalität Handschellen
কদিন আগের ঘটনায় পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেছবি: Fotolia/Gina Sanders

রাতের কলকাতায় এই নিগ্রহের ঘটনা হয়ত কিছুদিন পরে লোকে ভুলে যাবে৷ আক্রান্ত মেয়েটিই যেখানে শহর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেখানে সংবাদমাধ্যমও খুব বেশি দিন হয়ত আগ্রহী থাকবে না এই খবর নিয়ে৷ তবে শোনা যাচ্ছে, প্রশাসন বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে৷ যে চার জন এই ঘটনায় ধরা পড়েছে, তাদের যাতে কঠোর শাস্তি হয়, সেইভাবেই নাকি মামলা সাজাচ্ছে পুলিশ৷

তবে ওদের শাস্তি হবে কিনা, সেটা জানা না থাকলেও একটা ব্যাপার নিশ্চিত, বিদেশি পর্যটকদের জন্য লেখা গাইড বইতে এর পর লেখা হবে, মহিলারা কলকাতায় সাবধানে থাকবেন! ভারতের স্বঘোষিত সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে গর্বিত শহরের পক্ষে সেটা বড়ই লজ্জার বিষয় হবে, তাই নয় কি?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য