1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ: নায়ক না ভিলেন

১৯ মে ২০০৯

প্রভাকরণকে তাঁর সমর্থকরা 'সুর্যদেবতা' বলে উল্লেখ করলেও, বিরোধীরা কিন্তু নির্দয়' বলেই অভিহিত করতেন৷ একদিকে বীর যোদ্ধা হিসেবে নাম, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে অপনাম - ইতিহাসের পাতায় ঠিক এভাবেই থেকে গেলেন তিনি৷

https://p.dw.com/p/HtPi
ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ, ২০০২ সালের মে মাসে তোলা ছবিছবি: picture-alliance / dpa

আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা বা ইন্টারপোল প্রভাকরনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার সময় বলেছিল, প্রভাকরণ এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কোন মুহূর্তে ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম এবং আধুনিক সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারে অত্যন্ত পারদর্শী৷ এ কথা বলার মূল কারণ বোধ হয় এটাই যে, প্রভাকরণকে খুব কমই প্রকাশ্যে দেখা গেছে৷ অবশ্য নিহত এলটিটিই বিদ্রোহীদের স্মরণে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে একটি বারের জন্য জন সমক্ষে আসতেন প্রভাকরণ৷ দিতেন ভাষণ৷ যেমন গত বছর নভেম্বরে তিনি তাঁর সর্বশেষ ভাষণে বলেছিলেন, 'দখলদার সিংহলি বাহিনীকে আমাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে'৷ আর মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত সেই ব্যর্থ সংগ্রামই করে গেলেন প্রভাকরণ৷

Sri Lanka LTTE Führer Velupillai Prabhakaran Tamilen Tiger
অজানা অস্তানায় এলটিটিই গেরিলাদের সঙ্গে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ৷ ২০০৭ সালের মার্চে তোলা ছবিছবি: AP

জন্ম ও ছোটবেলা

১৯৫৪ সালের ২৬-শে নভেম্বর জাফনা উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত উপকূলীয় শহর ভেলভেত্তিয়াথুরাই-তে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাকরণ৷ মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট৷ শোনা যায়, প্রভাকরণ ছোটবেলায় নাকি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলেন৷ কিন্তু, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বই-এর পোকা প্রভাকরণ তামিলদের প্রতি শ্রীলংকার সংখ্যাগুরু সিংহলি জনগোষ্ঠীর বৈষম্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দেন৷ প্রভাকরণের কথায়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ পুরুষ সুভাষ চন্দ্র বসু এবং ভগত সিং তাঁকে প্রভাবত করেছিল৷ এছাড়া, আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট ও নেপোলিয়ানের জীবনও মুগ্ধ করেছিল প্রভাকরণকে৷

লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম

১৯৭৩ অথবা ১৯৭৪ সালে প্রভাকরণ 'তামিল নিউ টাইগারস' প্রতিষ্ঠা করেন৷ প্রথম দিকে এই সংগঠনটি তামিলদের প্রান্তিক অবস্থার প্রতিবাদকারী একটি সংগঠনের মতো কাজ করছিল৷ এক বছর পর যা লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিলএলাম বা এলটিটিই নামে গড়ে ওঠে৷ ১৯৭৫ সালে প্রভাকরণের বিরুদ্ধে জাফনার মেয়রকে হত্যার অভিযোগ ওঠে৷ আর তারপরেই টাইগাররা ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যদের দুর্ধর্ষ এক বাহিনীতে পরিণত হয়৷ পুরুষদের পাশাপাশি বহু নারী ও শিশুও যোগ দেয় প্রভাকরণের সঙ্গে৷ ফলত খুব শীঘ্রই অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন প্রভাকরণ৷ গড়ে তোলেন লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল এলাম-এর নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী৷ অর্থাৎ, প্রভাকরণের নেতৃত্বে তামিল টাইগাররা হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন গেরিলা বাহিনী৷

রাজীব গান্ধী হত্যা

১৯৯১ সালে চেন্নাইয়ের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য প্রভাকরণকে দায়ী করা হয়৷ বলা হয়, ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলংকায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশোধ নিতে রাজীবকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রভাকরণ৷ এরপর ভারতের একটি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং সন্ত্রাসবাদ, খুন ও সংগঠিত-অপরাধের অভিযোগে ইন্টারপোলের 'ওয়ান্টেড' তালিকায় নাম উঠে প্রভাকরণের৷ কিন্তু, এতেও ক্ষান্ত হন না প্রভাকরণ৷ ১৯৯৩ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা, ১৯৯৬ সালে কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৫ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামারসহ অসংখ্য মেয়র, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে এলটিটিই বাহিনী৷ আর এভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল গড়ে তুলতেও সক্ষম হন প্রভাকরণ৷

Rajiv Gandhi
১৯৯১ সালে চেন্নাইয়ের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য প্রভাকরণকে দায়ী করা হয়৷ছবি: AP

সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক বিশ্ব

শ্রীলংকা সরকার যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক উপায়ে তামিল বিদ্রোহ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় এরপর৷ একবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে দেশটিতে কিছুটা শান্তিও ফিরে আসে৷ ২০০৭ সালে নরওয়ের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা ভেঙ্গে গেলে, চূড়ান্তভাবে এলটিটিই বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয় কলম্বো সরকার৷ তারপর থেকে শ্রীলংকা সরকার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করলে, একের পর এক এলাকা তামিল বিদ্রোহীদের হাতছাড়া হতে থাকে৷ ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে টাইগারদের প্রশাসনিক রাজধানী কিলিনোচ্ছি হাতছাড়া হলে, শোচনীয় অবস্থায় পড়েন প্রভাকরণ৷ তবে গত কয়েক মাসে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর কাছে একের পর এক ভূখণ্ড হারাতে থাকে তামিল টাইগাররা৷ গুজব ছড়ায় যে প্রভাকরণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন৷

যবনিকা পতন

শ্রীলংকার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিলদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে তিন দশক ধরে লড়াই করছিলেন প্রভাকরণ৷ এর জন্য তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে গোপন আস্তানায়, জঙ্গলে-জঙ্গলে৷ কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর ক্ষমতাকে স্বপ্নপূরণের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি৷ স্বশাসিত তামিল আবাসভূমির স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যায়৷ সোমবার ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যা করে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে জয়ী হওয়ার ঘোষণা দেয় শ্রীলংকার সেনাবাহিনী৷ প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসে পার্লামেন্টে দেওয়া একটি ভাষণে এলটিটিই-র বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন মঙ্গলবার৷ দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল সারাথ ফোনসেকা জানান যে, মঙ্গলবার সকালে প্রভাকরণের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী৷ যদিও, তামিল টাইগারপন্থি একটি ওয়েবসাইট একইদিনে এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর খবর নাকচ করে দিয়ে দাবি করে, যে তিনি এখনও জীবিত ও নিরাপদ৷

প্রভাকরণের অন্যতম জীবনী লেখক এম.আর নারায়ন স্বামীর কথায়, সংগ্রাম করে মৃত্যুবরণকারী প্রভাকরণ তাঁর সমর্থকদের কাছে চীরদিন একজন কিংবদন্তি হয়েই থাকবেন৷

প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ, সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক