1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গর্ভপাত বিতর্ক: নারীর ইচ্ছা পূরণের অধিকার

২১ ডিসেম্বর ২০১১

কোট ঝোলানোর ইস্পাতের হ্যাঙ্গার ও আফিম মাখানো একটি ঝাড়ুর কাঠি পাকিস্তানের গর্ভপাতে ইচ্ছুক বেশির ভাগ নারীর শেষ ভরসা৷ ইসলামি রিপাবলিকে গর্ভপাত বেআইনি, যা অনেক মেয়েকে দিশাহারা করে তোলে৷

https://p.dw.com/p/13VKT
পাকিস্তানের এক নারীছবি: Pushto Film

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার দাউদ শাহ গ্রামের ১২ সন্তানের জননী ৩৮ বছর বয়স্ক জান্নাত বিবি পাঁচবার গর্ভপাতের পর অবশেষে সরকারি একটি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে যেতে রাজি হলেন৷ তাঁর ৫৪ বছর বয়স্ক ধাত্রী রোজিনা বলেন, জান্নাত বিবির স্বাস্থ্য নিয়ে কিছুটা সুপ্ত আতঙ্ক থাকলেও তাঁর গর্ভপাতের ব্যাপারে এখন তিনি একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন৷

আফিম বিস্ফোরণ
৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোজিনা এই গ্রাম ও আশেপাশের এলাকার মেয়েদের গর্ভপাতে সাহায্য করছেন৷ এজন্য তাঁর প্রয়োজন একটি ঝাড়ুর কাঠি ও আফিম, যা স্থানীয় বাজারে সহজেই পাওয়া যায়৷ কয়েক দশক ধরে চলা এই পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে রোজিনা বলেন, ঝাড়ুর একটি কাঠি গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার আগায় এক চিমটি আফিম লাগিয়ে তা জরায়ুতে ঢুকিয়ে দেন তিনি৷ ‘‘আফিম গর্ভকোষের মধ্যে বিস্ফোরকের মত কাজ করে'', বলেন রোজিনা৷ এক ঘন্টার মধ্যেই রক্তপাত শুরু হয়, যাতে বোঝা যায় গর্ভপাত সফল হয়েছে৷ গর্ভপাতের আরেক পদ্ধতিতে জরায়ুকে ফাটানোর জন্য কোট ঝোলানোর একটি ইস্পাতের হ্যাঙ্গারকে বাঁকা করে ব্যবহার করা হয়৷ যাতে নিরূপায় মেয়েদের জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়৷

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য গবেষণায় নিয়োজিত গুটমাখার ইন্সটিটিউটের ধারণা, পাকিস্তানে প্রতি ছয়ে একটি মৃত্যুই হয় অবৈধ গর্ভপাতের কারণে৷ দেশটিতে ৬০ শতাংশ গর্ভপাতই ঘটে অদক্ষ মানুষদের হাতে৷ বেশির ভাগই হয়ে থাকে পিছন দরোজার অবৈধ গর্ভপাত কেন্দ্রগুলিতে৷ জানান, নারী সংগঠন শির্কাত গাহ-এর মুখপাত্র ফৌজিয়া ভিকার৷ ২০১১ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত টের দ্য ফেম নারী কল্যাণ সংস্থার সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন তিনি৷

Pakistan Trauer Terrorattacke
ছবি: AP

লাহোরের হামিদ লতিফ হাসপাতালের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ও প্রশাসক ড. রুবিনা সোহেল মনে করেন, পাকিস্তানে গর্ভনিরোধের হার খুব কম৷ একারণে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের হারও অত্যন্ত বেশি৷ ড. রুবিনার বিশ্বাস, গর্ভনিরোধ ও নিরাপদ গর্ভপাতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলে লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করা গর্ভপাত কেন্দ্রগুলিও লুপ্ত হত৷ ড. সোহেলের মতে, অনেক মেয়েই অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের হাত থেকে বাঁচতেন, যদি তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকতো৷ ২০০৯ সালের জাতিসংঘের নারী উন্নয়ন তহবিলের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার বিবাহিত নারীদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷

ইচ্ছা বনাম ধর্ম
ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ করলেও গর্ভপাত করা নিষিদ্ধ৷ ফলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ করা মেয়েদের অবৈধ পথে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকেনা৷ বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য৷

জার্মানিতে ধর্মীয় বিধি নিষেধ থেকে আইন কানুনকে আলাদা করা হয়েছে, ফলে মেয়েরা সামাজিক কোনো চাপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কোনো সন্তান তারা চান কিনা৷ জার্মানিতে গর্ভপাতের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ৬০-এর দশকের শেষ দিকে ছাত্র বিপ্লবের সময় থেকে৷ ১৯৭৬ সালে জার্মান সরকার গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে৷ ধর্ষণের শিকার কোনো মেয়ে কিংবা গর্ভধারণের ফলে মায়ের জীবন বিপন্ন হলে গর্ভপাত আইনত সিদ্ধ৷  ১৯৯৫ সালে এই আইন পরিবর্তিত হয়৷
যৌনস্বাস্থ্য ও প্রজনন সংক্রান্ত বেসরকারি সংস্থা প্রোফামিলিয়ার পরামর্শদাতা কির্স্টিন মাইন্স রিল এ প্রসঙ্গে বলেন, গর্ভপাত এখনও দণ্ডনীয় অপরাধ৷ তবে এটা বৈধ, যদি গর্ভপাতের আগে মেয়েরা কোনো পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে পরামর্শ নেন৷

Verschleierte Frauen beim beten
ছবি: AP

জার্মানির ক্যাথলিক গির্জা এখনও জন্ম নিরোধ ও গর্ভপাতের বিপক্ষে৷ জার্মানিতে ১৭০০ সরকারি আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে, এর মধ্যে ২৭০টি রোমান ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা পরিচালিত৷

আজ এই দেশটিতে একজন মেয়ে গর্ভপাত করাতে পারেন, যদি তিনি স্বীকৃত কোনো সংস্থার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন৷ এ ছাড়া গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের মধ্যে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এবং ২০ সপ্তাহের মধ্যে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে গর্ভপাত করাতে পারেন মেয়েরা৷ তবে উভয় ক্ষেত্রেই গর্ভপাতের কারণে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সার্টিফিকেট থাকতে হয়৷

জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ের বিশেষ রিপোর্টার আনন্দ গ্রোভার বিশ্বব্যাপী গর্ভপাতকে বৈধ করার প্রস্তাব দেন৷ ২০১১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উপস্থাপিত রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, প্রজননের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা না থাকলে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করাও সুদূর পরাহত৷

ইতোমধ্যে প্রজননের ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইউরোপীয় সংস্থা ‘উইমেন অন ওয়েভস' সোচ্চার হয়েছে৷ সংস্থাটি পাকিস্তানে গর্ভপাত সংক্রান্ত একটি হটলাইন বসিয়েছে, যার মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা তথ্য দেয়া হয়৷ এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী ওষুধপত্র ও চিকিত্সার সুযোগ সুবিধা দেয়ার ব্যাপারেও তত্পর৷ তবে শুরু থেকেই সংস্থাটি পাকিস্তানের নানা ইসলামি গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলের বৈরিতার সম্মুখীন হচ্ছে৷

পাকিস্তানের ‘অ্যাওয়ার গার্লস' নারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা গুলালাই ইসমাইল উইমেন ওন ওয়েভস-এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত৷ তিনি বলেন, বিরোধিতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা মেয়েদের তাদের শরীর সম্পর্কে তথ্য দিয়ে তাদের শক্তিশালী করতে চাই৷ তারা এটা গ্রহণ করে নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷ এতে কোনো ভুল নেই৷'' 

প্রতিবেদন: আয়েশা হাসান /রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারূক