1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্যামেরাই যেখানে অস্ত্র

দেবারতি গুহ১৬ অক্টোবর ২০০৮

অদ্ভূত ক্ষমতার অধিকারী একটি ক্যামেরা৷ জীবনের নানা মুহূর্তকে ধরে ফেলে, খুব সহজেই একটি বিশ্বস্ত সূত্রে পরিণত হতে পারে একটি ক্যামেরা৷ তাই সাংবাদিকতায়ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে এটি৷ আর তার সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফারও৷

https://p.dw.com/p/FbSV
ফারজানা ওয়াহিদি-র ক্যামেরায় আফগান নারীছবি: AP

যেমন আফগানিস্তানের অন্যতম নারী ফটোসাংবাদিক ফারজানা ওয়াহিদি৷

সম্প্রতি আফগানিস্তানে আরো এক হাজার বাড়তি সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মানি৷ স্বাভাবিকভাবেই, তালেবানদের কবল থেকে আফগানিস্তানকে এখনো সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায়নি৷ পূর্বে ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে চীন - আফগানিস্তানের এই ভৌগোলিক অবস্থান একদিকে যেমন অস্ত্র-শস্ত্রের বে-আইনী পাচার, মাদকদ্রব্যের চোরা-চালান এবং সংঘটিত অপরাধকে বাড়িয়ে তুলেছে, তেমনই সরকারি দপ্তরে জালিয়াতি এবং ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লংঘন শুধু অস্থিতিশীলই নয়, মৌলবাদী করে তুলছে আফগানিস্তানকে৷ এমতাবস্থায় একজন মহিলা ফটোগ্রাফার, এক্ষেত্রে ফারজানা ওয়াহিদি যখন স্বাধীনভাবে তাঁর কাজ করতে উদ্দ্যোগী হন, তখন তার চলার পথে বাধা যে আসবে - তা তো বলাই বাহুল্য !

ফারজানা ওয়াহিদি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছবি তুলতেন৷ তাঁর প্রথম তোলা ছবিটা ছিল এমন - আফগানিস্তানের জাতীয় পোশাক পরা একটি বয়স্ক মানুষ৷ পরনে সাদা সালোয়ার, সঙ্গে লম্বা হাতার কামিজ, মাথায় আফগানি টুপি৷ ছবিতে তাঁকে দেখা যায় পিছন ফিরে হেঁটে যেতে৷ এমন একটা পথে, যা দিগন্তব্যাপী৷ যার শেষ দেখা যায় না, কিছুতেই৷ ফারজানা ওয়াহিদি এতোদিন পরেও যেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পারেন সে দৃশ্য : ছবিটা কাবুলের খুব পুরোনো একটা অঞ্চলে তোলা৷ ছবিটা একসময় আমার শিক্ষকের অত্যন্ত প্রিয় ছিল৷ যেই আমাদের স্কুলে আসতেন, তাকেই ছবিটা বেশ আগ্রহভরে দেখাতেন তিনি৷

এখন ফারজানার বয়স ২৫৷ আর এখনো ফারজানার নিত্যদিনের সঙ্গী তাঁর ক্যামেরা৷ তাঁর তোলা ছবি৷ কোন যুদ্ধ, কোন আপোশেই হার মানেন নি ফারজানা৷ ১৯৮৯ সালের গৃহ-যুদ্ধ, তালেবান শাসন, ২০০১ সালের ১১-ই সেপ্টেম্বর টুয়িন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমন, এমনকি দেশের সামগ্রিক অবক্ষয় এবং চিরাচরিত পুরুষতন্ত্রের যাতাকলে পিষ্ট হয়েও, ফারজানা হাল ছেড়ে দেননি৷

আর তাই, আজ তিনি আফগানিস্তানের কনিষ্ঠ ও ব্যস্ততম মহিলা-ফটোগ্রাফার৷ দীর্ঘ ১৩ বছর যাবত ক্যামেরাই তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, তাঁর ভালোবাসা৷ ফারজানার কথায় : খুব ছোটবেলায় ফটোগ্রাফি কিন্তু আমার একদম ভালো লাগতো না৷ স্বপ্ন দেখতাম - সাংবাদিক হবো৷ দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবো৷ সারা বিশ্বের সামনে আফগানিস্তানকে, দেশের অবস্থা, এখানকার মানুষদের সমস্যাগুলি তুলে ধরবো৷ তবে সবচেয়ে বেশি আমি চাইতাম একজন স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠতে৷ চাইতাম বাবা-মাকে সাহায্য করতে৷ চাইতাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে৷ আর তার জন্য স্কুলে থাকতে থাকতেই আমাকে কাজ করতে হতো৷ সব রকমের কাজ৷

এভাবেই চলছিল৷ কিন্তু তারপর, একদিন হঠাত্-ই ঘটে গেল একটা অঘটন৷ ফারজানা তখন সবেমাত্র নবম শ্রেণীতে৷ শুনতে পেলেন, চলচ্চিত্র নির্মানের সঙ্গে ফটোজার্নালিজমেরও কোর্স দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ভাবলেন - ফটোজার্নালিজম - বাহ্, বেশ তো ! ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন সাংবাদিকতাও করা যাবে৷ ব্যাস্, ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়ে দিলেন৷ তারপর কি হলো ? জানাচ্ছেন ফারজানা নিজেই : তখন আমার মাত্র ১৭ বছর বয়স৷ ভেবেছিলাম হবে না৷ বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম৷ তাই করেছিলাম কি - পাসপোর্টে জন্মতারিখ ৫ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলাম৷ মানে একলাফে আমার বয়স বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২২-এ৷ এরপর ঠিক দু-সপ্তাহ৷ আর তারপরেই এসে গেল চিঠি৷ আমি পাস করেছি৷ চান্স পেয়ে গেছি৷

ফারজানা ওয়াহিদি এখন বিশ্বের অন্যতম সংবাদসংস্থা আসোসিয়েটেড প্রেস বা এপি-র সঙ্গে যুক্ত৷ খুব ব্যস্ত তাঁর জীবন৷ সকাল-সকাল অফিসে যাওয়া, ই-মেল চেক করা, হাজার রকম বিষয় নিয়ে গবেষণা করা, ফিল্ড-এ যাওয়া, ছবি তোলা, তারপর সেগুলি ডেভেলাপ করা, পাঠানো, আরো কতো কি ! কিন্তু, আফগানিস্তানের মতো একটা দেশে এমন একা-একা কাজ করতে নিরাপত্তাবোধের অভাব হয় না ? ফারজানা জানালেন : বোমা-হামলা, যুদ্ধ - এসব আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে৷ ছোটবেলা থেকেই৷ মনে হয় আমার ছোটবেলায় দেখা কোন ঘটনা আমাকে এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে৷ তারপরও কাজ করি৷ করতে হয়৷ একজন পুরুষের মতোই৷ কিন্তু, এক-এক সময় খুব ক্লান্ত লাগে৷

আফগানিস্তানের নতুন সংবিধানটি প্রণীত হয় ২০০৪ সালে৷ চালু হয় একটি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা৷ অথচ, তারপরও নারীকে সম অধিকার দেওয়া হয়নি আফগানিস্তানে৷ একজন নারীকে ক্যামেরা হাতে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে দেখে কখনো কটাক্ষের স্বীকার কি হননি তিনি ? স্পষ্টবাদী ফারজানা : আমি এমন পুরুষ চিনি, যারা একজন নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হতে দেখে উত্সাহিত বোধ করে৷ কিন্তু, এমনও বহু পুরুষ আছে যারা নারীদের সব সময়ই পর্দার আড়ালে দেখতে চান৷ তার ওপর হাতে ক্যামেরা থাকলে তো হয়েই গেল৷ এ-ধরনের মানুষকে আমি বিশেষ তোয়াক্কা করি না৷ চাইলে, আমি সব কিছু করতে পারি - এটাই আমার বিশ্বাস৷

অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত All Roads Film Festival-এ ফারজানা ওয়াহিদির ছবির একটি সিরিজ প্রদর্শিত হচ্ছে৷ বিষয় ছিল - আফগান নারীর গল্প৷ যাতে একমাত্র অস্ত্র ঐ ক্যামেরার সাহায্যে ছবির পর ছবি সাজিয়ে, আঁটোসাঁটো এক গল্প লিখেছেন ফারজানা৷ অথচ, ফারজানার নিজের জীবনটাও একটা গল্প নয় কি?