ইইউ নির্বাচনের পর কোন্দল
২৯ মে ২০১৪
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে মধ্য-ডান ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) সর্বাধিক আসন সংগ্রহ করলেও, তাদের মুখ্য প্রার্থী, লুক্সেমবুর্গের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জঁ-ক্লোদ ইয়ুংকারের ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট হবার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, কমপক্ষে দূরাহত হয়ে এসেছে৷
তার কারণও সহজ: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইয়ুংকারের মনোনয়নের বিরোধী৷ তাঁর দৃষ্টিতে ইয়ুংকার হলেন পুরনো আমলের ইউরোপীয় ফেডারালিস্ট৷ ওদিকে ব্রিটেনে ইইউ-বিরোধী ইউকেআইপি দলের ব্যাপক সাফল্যের পর ক্যামেরনকে এখন ইউরোপ প্রসঙ্গে আরো কড়া হতে হচ্ছে৷
কাজেই ক্যামেরন ব্রাসেলস সম্মেলনের সূচনাতেই ‘‘চেঞ্জ’’, অর্থাৎ পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন: ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নির্বাচনের ফলাফলকে উড়িয়ে দিয়ে ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’ করতে পারে না৷ ইউরোপের চাই পরিবর্তন – এই হলো ক্যামেরনের যুক্তি৷
‘‘আমাদের এমন একটা মনোভাব চাই যা স্বীকার করে নেবে যে, ব্রাসেলস মাত্রাধিক রকম বড়, কর্তৃত্বমূলক ও অকারণ হস্তক্ষেপ প্রবণ,’’ বলেছেন ক্যামেরন৷ ‘‘আসলে হওয়া উচিত: যতদূর সম্ভব জাতিভিত্তিক, একক দেশ, এবং যেখানে প্রয়োজন, শুধুমাত্র সেখানেই ইউরোপ৷’’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকেও দেখতে হয়েছে, ইইউ এবং অভিবাসন বিরোধী ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিভাবে নির্বাচনে সারা দেশ জয় করেছে৷ ওলঁদ এখন চান, ইইউ প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, জ্বালানিশক্তি এবং সীমান্তে সুরক্ষা (অর্থাৎ বস্তুত অভিবাসন রোধ) ইত্যাদি বিষয়ের উপর মনোনিবেশ করুক৷
বস্তুত ‘‘চেঞ্জ’’-এর ডাক এবার এসেছে ছোট-বড় সব দেশ থেকে৷ লিথুয়ানিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যদি বলে থাকেন, ‘‘সব ইউরোপীয় নেতার দায়িত্ব হলো ইউরোপকে বদলে দেওয়া’’, তাহলে ইটালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ইউরোপেকে যে বাঁচাতে চায়, তার ইউরোপকে বদলাতে হবে৷’’
ইউরোপকে বদলানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ হবে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন৷ সংসদীয় রীতি অনুযায়ী ইপিপি-র মুখ্য প্রার্থী জঁ-ক্লোদ ইয়ুংকারেরই কমিশনের প্রেসিডেন্ট হবার কথা৷ লিসবন চুক্তি অনুযায়ী কিন্তু ইইউ নেতৃবর্গ সেটা মেনে নিতে বাধ্য নন৷
ইয়ুংকারকে কেন্দ্র করে বিরোধটা জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মধ্যে প্রকাশ্য ক্ষমতার লড়াইয়ে পর্যবসিত হতে পারত, কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই জানেন যে, ইইউ-কে এবার আপোষের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে৷
বাস্তবে করাও হয়েছে তাই৷ খোদ ম্যার্কেল ইয়ুংকারের প্রতি নরম-গরম সমর্থন দেখিয়ে বস্তুত ইপিপি প্রার্থীর নিশ্চিত জয়টাকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছেন৷ এটা আবার ইউরোপীয় সংসদের প্রতিও একটা সিগনাল: কেননা সংসদের রক্ষণশীল এবং সমাজতন্ত্রী জোটের সদস্যরা মোটামুটি ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে, ইয়ুংকার কমিশনের প্রেসিডেন্ট হবেন এবং সমাজতন্ত্রীদের মুখ্য প্রার্থী মার্টিন শুলৎস হবেন তাঁর ডেপুটি৷
ইউরোপীয় সংসদ যে এভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, ইইউ-এর সর্বোচ্চ পদটি কে অলঙ্কৃত করবেন – আর ইউরোপীয় পরিষদ সেটা মুখ বুজে মেনে নেবে, তা কল্পনা করাই ভ্রম৷ ঘটেছেও ঠিক তাই: ইইউ-এর স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতি অনুযায়ী অনেকে অনেক কিছু বলেছেন, আবার অনেকের কিছু না বলাটাই একটা মহৎ বিবৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
মোট কথা, ম্যার্কেল বলেছেন, যেহেতু কোনো জোটই সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, সেহেতু কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি ‘‘প্রশস্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার’’ প্রয়োজন৷ ইপিপি-র সদস্য হিসেবে তিনি ইয়ুংকারকে সমর্থন করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে লিসবন চুক্তিকেও সম্মান করে চলতে হবে, বলেছেন ম্যার্কেল৷
সব মিলিয়ে টানাপোড়েনটা চলবে আপাতত ইউরোপীয় সংসদ ও ইউরোপীয় পরিষদের মধ্যে৷ আপোষ হিসেবে ইইউ-এর প্রেসিডেন্ট হ্যার্মান ফান রম্পয়কে ইউরোপীয় সংসদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসতে বলা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে এই প্রক্রিয়া কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস ধরে চলতে পারে৷
সংসদের সঙ্গে বিরোধও চরমে উঠতে পারে৷ অথচ এই মুহূর্তে ‘‘ইউরোপের কোনো নতুন সংকটের মুখোমুখি হবার মতো শক্তি নেই’’, বলেছেন লুক্সেমবুর্গের প্রধানমন্ত্রী সাভিয়ের বেটেল৷
এসি/ডিজি (রয়টার্স, এএফপি)